যদিও মার ওই লেখা সম্পর্কে খুব একটা উচ্চ ধারণা ছিল না পারুলের, বরং মার তীব্রতা, মার আবেগ, মার সব বিষয়ে তাল ঠুকে প্রতিবাদ আর বিদ্রোহ করা, এসবকে পারুল খুব অবজ্ঞার চোখেই দেখতো, জানতো মার লেখাও ওই পর্যায়ের, কাজেই মূল্যবোধ কিছু ছিল না তার সম্বন্ধে, তবু এখন একটু উল্লেখ করলো।
ব্যর্থতার তুলনা করতে করলো উল্লেখ।
বকুল চুপ করে থাকলো।
বকুলের হঠাৎ সেই এক লহমার জন্য দেখা আগুনের আভায় স্পষ্ট হয়ে ওঠা মুখটা মনে পডালো।
সে মুখ পরাজিত সৈনিকের না। অপরাজেয় কাঠিন্যের, আজ পর্যন্ত ঠিক করতে পারে নি বকুল।
তা হয়তো পরাজিতেরই।
হয়তো সুবর্ণ ওই দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দেওয়ালের লেখা পড়ে না, লেখে সেখানে। অদৃশ্য কালিতে রাখে বঞ্চনা-জর্জর পীড়িত আত্মাদের ইতিহাস। না, শুধু তার নিজের কথা নয়, লক্ষ লক্ষ আত্মার কথা। পরবর্তীকাল পড়বে ওই লেখা।
কে জানে তখন আবার তার প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নেবে। কিনা আর এক নতুন জাতি— উদ্ধত, অবিনয়ী, অসহিষ্ণু, অসন্তুষ্ট, আত্মকেন্দ্ৰিক।
দেওয়ালের লেখাও তো শেলেটের লেখার মত একবার লেখা হয়, একবার মোছা হয়। আজ হয়তো এক হৃতসর্বস্ব সৈনিক পরাজয়ের কথা লিখে রেখে যাচ্ছে, আগামী কাল–
কিন্তু সত্যিই কি তবে এবার যাচ্ছে সুবৰ্ণলতা? তা নইলে এত ভেঙে পড়েছে কেন? উঠতে যদি পারেও, উঠতে চায় না।
বিছানাতেই রাতদিন।
মেজেয় মাদুরের ওপর পাতা বিছানা, ঘরমোছা-ঝি জ্ঞানদা এসে বলে, একটু যে উঠতে হবে মা–
আগে আগে উঠছিল সুবর্ণ, আজকাল বলে, আর উঠতে পারি না বাপু, পাশ থেকে মুছে নিয়ে যাও।
আর মাঝে মাঝে বলে, দক্ষিণের ওই বারান্দাটায় একটা চিক টাঙিয়ে দিলে ওইখানেই শুতাম–
প্ৰবোধ শুনতে পেয়ে রাগ করে বলে, ওই খোলা বারান্দায় শোবে? এই নিত্যি জ্বর—
ঘুষঘুষে জ্বরে খোলা হাওয়া ভাল, সুবর্ণ একটু হেসে বলে, তাছাড়া দক্ষিণের বারান্দায় মরবার যে বড় সাধ আমার!
ওসব অলুক্ষণে কথা বোলো না মেজবৌ—, প্ৰবোধ গুম হয়ে যায়।
সুবৰ্ণ বলে, অলুক্ষ্মণে কি গো? এখন মরলে জয়জয়কার! যাক গে, মরছি না তো— মরবোও না। তবে রাত্তিরে কেসে মরি, তোমার ঘুম হয় না—
তা কথাটা মিথ্যে নয়।
ও দেওয়ালের একবারে ও প্রান্তে উঁচু খাটে ঝালর দেওয়া বালিশ-তাকিয়ায় ঘেরা যে বিছানাটি বড় শুরুমুখ্যা ছিল, প্ৰবোধের সেখানে আর নিশ্চিন্তে ঘুমানো যাচ্ছে না।
ওই কাসি।
কাসির শব্দ হলেই কেমন যেন ঘরে টিকতে পারে না প্ৰবোধ, দরজা খুলে বেরিয়ে দালানের চৌকিতে এসে বসে।
তবু প্ৰতিবাদ করে প্রবোধ, বাঃ, শুধু আমার ঘুমটাই বড় হলো? তুমিও তো কেসে কেসে—, কিন্তু প্ৰতিবাদের সুরাটা যেন দুর্বল শোনায়।
সুবৰ্ণ দেওয়ালের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, তা নিজেকে তো নিজের কাছ থেকে সরিয়ে নেবার উপায় নেই?
আজও আবার সেই কথাই ওঠে।
কারণ গতরাত্রে প্রবোধ প্রায় সারারাতই ভিতরন্দালানে কাটিয়েছে। তবু আজ যেই সুবর্ণ দক্ষিণের বারান্দায় চিক ফেলার কথা বলে, প্ৰবোধ পাড়া জানিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, এই বকুল, দাদাদের বল মুটে ডেকে আমার খাটখানা ওই ছোট ঘরে নিয়ে যাক! ওখানেই শোবো। আমি আজ থেকে। কাসির জন্যে নাকি ঘুমের ব্যাঘাত হয় আমার, তাই একটা রুগী যাবে খোলা বারান্দায় শুতে!
ঘরে দাঁড়িয়ে নয়, ঘর থেকে বেরিয়ে চেঁচায়।
সুবৰ্ণ যেন সেই চেঁচানিটার দিকেই একটা রহস্যময় ব্যঙ্গহাসির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
ব্যবস্থাটা করে দিল সুবল।
বাবার নয়, মার।
কোথা থেকে যেন খান্নতিনেক চিক আর ত্রিপল এনে বারান্দায় বুলিয়ে দিয়ে মার বিছানাটা তুলে নিয়ে গেল। সেখানে। নিঃশব্দে, সকলের অগোচরে।
বলেছিলও সুবর্ণ সকলের অগোচরে।
সুবৰ্ণ কি ভেবেছিল, হাতে মজুত এই বাক্সটার সীল আমি ভাঙবই? তাই বলেছিল সুবৰ্ণ, সুবল, কখনো তো কিছু অনুরোধ করি নি। বাবা, একটা অনুরোধ রাখবি? দক্ষিণের বারান্দায় মরবার বড় শখ হয়েছে। করে দিবি ব্যবস্থা?
সুবল উত্তর দেয় নি, বোঝা যায় নি করবে। কিনা, কিন্তু খানিক পরেই দেখা যায় বারান্দায় পর্দা ঘিরছে।
২.২৭ কেদার-বদরি ফেরত
কেদার-বদরি ফেরত মাসখানেক বারাণসীতে কাটিয়ে, দীর্ঘদিন পরে কলকাতায় ফিরলেন জয়াবতী। আর এসেই দুদিন পরে দেখতে এলেন সুবৰ্ণকে।
দেখলেন নতুন ব্যবস্থা।
দেখলেন জীর্ণ অবস্থা।
কাছে বসে পড়ে বললেন, মানুষের ওপর অভিমান সাজে সুবর্ণ, ইটপাথরের ওপর অভিমান করে নিজেকে শেষ করার বাড়া বোকামি আর কি আছে?
সুবৰ্ণ হেসে বলে, জানোই তো চিরকেলে বোকা! কিন্তু অভিমানটা ইঁট-পাথরের ওপর এ কথা কে বললো? যদি বলি সৃষ্টিকর্তার ওপর?
তা সে লোকটাও তো ইট-পাথর!
তবে নাচার।
বৌমা বলছিল, শরীরের ওপর অবহেলা করে-করেই নাকি রোগটি বাধিয়েছ!
ওরা মা বলে ব্যস্ত হয়, তাই ওকথা বলে, মরণকালে তো একটা কিছু হবেই?
তা কালটাকে তো স্বেচ্ছায় ত্বরান্বিত করছিস! শুনলাম ওষুধ খাস না, পথ্যি খাস না, বৌরা সেবা-যত্ন করতে এলে নিস না–এটা তো ঠিক নয় ভাই!
সুবৰ্ণর ব্যাধি-স্নান চোখ দুটো একবার জ্বলে উঠলো, তারপর ছায়া হয়ে গেল। বললো, ওই তো বললাম, চিরকেলে বোকা!
জয়াবতী বললেন, তা তো জানি। সংসারে যে পুরো খাঁটিতে কাজ চলে না, ন্যায়ে আর অন্যায়ে, সত্যিতে আর মিথ্যেতে আপস করে নেওয়া ভিন্ন যে সংসার অচল, এ কথা তো কখনো বুঝিয়ে পারি না তোকে। কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে নাই বা সরে পড়লি? একজন তো কোনকালে ফেলে চলে গেছে, তুই গেলে যে একেবারে নির্বান্ধব!