চিত্ৰগুপ্ত এ প্রশ্নে পকেট থেকে দূরবীক্ষণ যন্ত্র বার করে চোখে লাগিয়ে কিছুক্ষণ মর্ত্যধামের দিকে সন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দ্বিধাযুক্ত স্বরে উত্তর দিলেন, তা তো ঠিক মনে হচ্ছে না। বরং ষোলো আনা সুখের অবস্থাই তো দেখছি।
তবে?
চিত্ৰগুপ্ত মাথা চুলকে বললেন, আজ্ঞে সে হিসেব দেখতে হলে তো সময় লাগবে। এসব গোলমেলে লোকেদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা।
বিধাতাপুরুষের কেরানী কবে আবিষ্কার করতে পেরেছিল সুবৰ্ণলতার উল্টোপাল্টা প্রকৃতির কারণ রহস্য, কবে সে বিবরণ পেশ করেছিল মনিবের দরবারে, কে জানে সে কথা!
হয়তো করেই নি।
হয়তো বিধাতা পুরুষও আর সে নিয়ে মাথা ঘামান নি। মুহূর্তে মুহূর্তে কত কোটি কোটি বার ঘণ্টি পড়ছে, কত হাজার কোটি লোক আসছে, বামুনদের সুবৰ্ণলতাকে কে মনে করে বসে থেকেছে?
প্রশ্নটা তাই নিরুত্তর থেকে গেছে।
শুধু সুবৰ্ণলতা যতদিন বেঁচে থেকেছে, অহরহ তাকে ঘিরে এ প্রশ্ন আছড়ে আছড়ে পড়েছে।
সংসারসুদ্ধ সবাই খাচ্ছে ঘুমোচ্ছে হাসছে খেলছে ছেলে ঠেঙাচ্ছে ছেলে আদর করছে গুরুজনকে মান্য করছে গুরুজন রাগ করলে চোর হয়ে থাকছে, নিয়মের ব্যতিক্রম নেই, শুধু মেজবৌই রাতদিন হয় ঠিকরে বেড়াচ্ছে, নয় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছে। নয়তো এমন একটা কিছু কাণ্ড করে বসছে যা দেখৈ স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছে লোকে। কী করবে। লোকে এ বৌকে নিয়ে?
গুরুলঘু জ্ঞানের বালাই নেই, কিছুতে সন্তোষ নেই।
কেন?
কেন?
কী তুমি এমন রাজকন্যে যে কিছুতে মন ওঠে না? আর কথাই বা এত কটকটে কেন শুনি?
প্রথম ছেলে।পুলে হচ্ছে, লজ্জায় মাথা হেঁট করে বসে থাকবি, তা নয়, আঁতুড়ঘরে ঢোকার মুখে বলে কিনা, এত সব ময়লা ময়লা কাপড় বিছানা দিচ্ছেন? ও থেকে অসুখ করে না বুঝি? উমাশশী সেই ছেঁড়া কথা কাপড়গুলো নামিয়ে এনে ধপ করে ফেলেই নাকটায় আঁচল দিয়েছিল, ওর থেকে লাফিয়ে ওঠা ধুলোর থেকে আত্মরক্ষা করতে।
জায়ের কথা শুনে চমকে আঁচল ছেড়ে শঙ্কিত দৃষ্টি মেলে শাশুড়ীর দিকে তাকালো। হে ভগবান, যেন শুনতে না পেয়ে থাকেন!
কিন্তু ভগবান উমাশশীর প্রার্থনা কানে নেবার আগেই মুক্তকেশীর কানে পৌঁছে গেছে তাঁর বধুমাতার বাণী।
মুক্তকেশী। তখন ছেলের নাড়ী কাটবার জন্যে চ্যাঁচাড়ি গুছিয়ে রাখছিলেন। প্রসববেদনার বাড়াবাড়িটা হবার আগেই সব কিছু গুছিয়ে রাখেন সুগৃহিণী মুক্তকেশী। অবিশ্যি ইতিপূর্বে বৌয়ের আঁতুড় তুলতে তাঁকে হয় নি। বড়বৌমার মা গরীব দুঃখী বিধবা মানুষ হলেও প্রথম দ্বিতীয় দুবারই মেয়েকে কাছে নিয়ে গেছেন। মুক্তকেশী যা করেছেন নিজের মেয়েদের। তবে আসলে পোক্ত হয়েছেন জা ননদ ভাসুরঝি দ্যাওরঝিদের ওপর হাত পাকিয়ে। একান্নবতী সংসার ছিল তো আগে।
তা ছাড়া হাঁড়ি ভেন্ন হলেও আপদে বিপদে সবাই সবাইয়ের করেছে। মুক্তকেশী বেশি করিৎকর্ম বলে বেশি করেছেন।
কিন্তু মুক্তকেশী কি এতখানি বয়সে—এমন দুঃসাহসিক স্পর্ধার কথা শুনেছেন কখনো?
না, জীবনে শোনেন নি।
প্রসব-বেদনায় ছট্ফট করতে করতে যে কোনো ঝি-বৌ এতটা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে পারে, এ মুক্তকেশীর ধারণার বাইরে, জ্ঞানের বাইরে, স্বপ্নের বাইরে।
হাতের চ্যাঁচাড়ির সুয়ো হাতে ফুটিয়ে থ হয়ে গিয়ে বলে ওঠেন মুক্তকেশী, কি বললে মেজবৌমা?
মেজবৌমা প্ৰায় গোল হয়ে শুয়ে উঃ আঃ করছিল, তবু ওর মধ্যেই বলে উঠল, শুনতে তো পেলেন। ওই ধুলো-ভর্তি ময়লা পুরনো বিছানা কাঁথায় অসুখ করবে, সেই কথা বলছি।
মুক্তকেশী রান্নাঘরের বড় উনুনটার মতন গনগনিয়ে বলে ওঠেন, আমার এই কপালটা দেয়ালে ঠকে ফাটাতে ইচ্ছে করছে মেজবৌমা, নইলে কোনদিন নিজের আগুনে নিজেই ফেটে পড়বো! অ্যাঁ! বললে কী তুমি? বললে কী, পুরনো বিছানায় রোগ জন্মাবে তোমার? আঁতুড়ঘরে যে কথা কেউ না শুনেছে, সেই সব কথা আমায় শুনতে হচ্ছে পদে পদে? … তবে? কী করতে হবে তাহলে? নবাব-নন্দিনীর জন্যে সাটিনের বিছানার বায়না পাঠাতে হবে? তবে একটু ধৈর্য ধরে থাকো বাছা, এক্ষুণি ঘরের ডাক বাইরে আর বাইরের ডাক ঘরে করে বাড়ি তোলপাড় করো না। পেটের পো পেটে রেখে বসে থাকো, আমার ত্যাড়াকান্ত ছেলে আসুক আপিস থেকে, বলি তাকে বিছানার কাহিনী!
সুবৰ্ণর তখন ছটফটানি শুরু হয়ে গেছে, তবু সুবৰ্ণ জবাব দিতে ছাড়ে না। মূর্খ সুবর্ণ, অবোধ সুবৰ্ণ, সংসার-জ্ঞানহীনা সুবৰ্ণ!
বলে, যাক গে বাবা থাক! আমার তো মরণ হলেই মঙ্গল!
মুক্তকেশী সহসা নিজের গালে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় বসিয়ে বলে ওঠেন, তোমার মরণ হলেই মঙ্গল? অ্যাঁ! ও রাজু, মাথায় জল দে!
রাজু অবশ্য জল আনল না, মুক্তকেশী বিনা জলেই চাঙ্গা হয়ে আবার বলেন, তাহলে এও বলি মেজবৌমা, এমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলতে তোমার মায়া হয় না? এ কী আমার করবার কথা? প্রেথম পোয়াতী শ্বশুরঘরে আঁতুড় পেতেছে শুনেছ। কখনো? না দেখেছি কখনো? বলি মা-ই না হয় তোমার কুলের ধ্বজা বাপ মিনসে তো আছে? বাপ আছে, ভাইভাজ আছে, কাছের গোড়ায় একটা পিসি রয়েছে, নিয়ে যেতে পারল না? নতুন সাটিন মখমলের বিছানায় শুইয়ে আঁতুড় তুলতো বাপ!
আর উত্তর-প্রত্যুত্তরের ক্ষমতা ছিল না। সুবৰ্ণলতার, তবু শেষ একটা কথা বলে নেয়, বাবা যখন নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তখন তো কই পাঠান নি, এখন দোষ দিচ্ছেন কেন?
সুবৰ্ণ যন্ত্রণায় ছটফট করছে, মুক্তকেশীও হাড়ি ধাই গঙ্গামণির আগমন আশায় ছটুফট করছেন, ৩ত্ৰাচ এই বাকযুদ্ধ।