সুবৰ্ণ ছাড়া আর কেউ ছাতে উঠতে না পাওয়াটা মস্ত একটা লোকসান ভাবে নি। সে বাড়িতে।
১.০৫ সুবৰ্ণলতার শ্বশুরবাড়ির আর কেউ
না, সুবৰ্ণলতার শ্বশুরবাড়ির আর কেউ ছাতে ওঠবার সিঁড়িটার প্রয়োজন অনুভব করে নি। রান্নাঘরের নীচু ছাতটা তো রয়েছে দোতলায়, তা ছাড়া উঠোনটাও রয়েছে অত বড়, এতে আর গোরস্তর কাপড় শুকোতে দেওয়া, বিছানা রোদে দেওয়া, কি বড়ি আচার আমসত্ত্ব জারকলেবুর চাহিদা মিটবে না?
মিটছে, অনায়াসেই মিটছে। সিঁড়ি থাকলেই বা কে ওই তিনতলার fi। মাথায় উঠতে যেতো। ওই সব বোঝা বয়ে?
সুবৰ্ণলতার সবই ক্ষ্যাপামি।
বলে কি না—আমি বইব। তোমরা সিঁড়ি কর, দেখো, সারা সংসারের সমস্ত ভিজে কাপড় কথা বিছানার বোঝা বয়ে নিয়ে যাব আমি। আচার, আমসত্ত্ব, বড়ি? তাও তসর মটকা পরে দিয়ে আসব, নামিয়ে আনব। কাউকে সিঁড়ি ভাঙতে হবে না।
কিন্তু ওর এই ক্লেশ স্বীকারের প্রতিশ্রুতিতেও উৎসাহিত হয় নি কেউ। খাওয়া নয়, পরা নয়, কিনা ছাতে ওঠা! এর জন্য মানুষের খিদেতেষ্টার মত ছটফটানি ধরেছে এটা ন্যাকামির মতই লেগেছে ওদের কাছে। ন্যাকামি ছাড়া আবার কি?
একটুকরো বারান্দা, ছাতে ওঠবার একটা সিঁড়ি, এ যে আবার মানুষের পরম চাওয়ার বস্তু হতে পারে, এ ওদের বুদ্ধির অগম্য।
বরং সুবৰ্ণলতার স্বামীর তীক্ষ্ণবুদ্ধির কাছে আসল তথ্যটা ধরা পড়েছিল। সুবৰ্ণলতার এই আকুলতার পিছনে যে কোন মনোভাব কাজ করছে তা আর বুঝতে বাকী থাকে নি প্ৰবোধের।
ছাদে উঠে পাঁচবাড়ির জানালায় বারান্দায় উঁকিঝকি দেওয়ার সুবিধে, নিজেকে আর দশজোড়া উঁকিঝকি মারা চোখের সামনে বিকশিত করার সুবিধে, আর বিশ্বাস কি যে চিল বেঁধে চিঠি চালাচালির সুবিধেটাও নয়?
প্ৰবোধের তাই সিঁড়িতে প্ৰবল আপত্তি।
সুবোধ বরং কখনো কখনো বলেছে, বোনাসের টাকাটা বেড়েছে, লাগিয়ে দিলে হয় সিঁড়িটা! প্ৰবোধের প্রতিবন্ধকতাতেই সে ইচ্ছে থেকে নিবৃত্ত হয়েছে সুবোধ।
বুদ্ধিমান ভাই যদি বলে, মাথা খারাপ? ওই টাকাটা সংসারের সত্যিকারের দরকারী কাজে লাগানো যাবে। নিবিরোধী দাদা কি সে কথার প্রতিবাদ করে? না, করতে পারে?
আর সত্যি, গোরস্তর সংসারে তো দরকারের অন্ত নেই। বিছানা বালিশ, জুতো জামা, র্যাপার চাদর, এ সবে তো ঘাটতি আছেই সব সময়। মুক্তকেশীর তীর্থখরচ বাবদও কিছু রাখা যায়। পাড়ার গিন্নীরা যখন দল বেঁধে তীর্থধর্ম করতে যান, মুক্তকেশী তাদের সঙ্গ না নিয়ে ছাড়েন না। তখন ছুটোছুটি করে টাকাটা যোগাড় করতে হিমসিম খেতে হয় ছেলেদের। হাতে থাকলে—
এইসব দরকারী কাজ থাকতে, টাকা ঢালতে হবে ইটের পাঁজায়?
অতএব সুবৰ্ণলতার কম্পিত আশার কুড়ির উপর পাথর চাপা পড়ে।
কিন্তু সুবৰ্ণলতার চাওয়ার সীমানা কি ওইটুকু মাত্র? একটুকরো বারান্দা, ছাদে ওঠবার একটা সিঁড়ি? ব্যস? আর কিছু নয়? জীবনভোর শুধু ওইটুকুই চেয়েছে সুবৰ্ণলতা?
না, তা নয়।
বেহায়া সুবৰ্ণ আরো অনেক কিছু চেয়েছে। পায় নি, তবু চেয়েছে। চাওয়ার জন্যে লাঞ্ছিত হয়েছে, উৎপীড়িত হয়েছে, হাস্যাম্পদ হয়েছে, তবু তার চাওয়ার পরিধি বেড়েই উঠেছে।
সুবৰ্ণলতা ভব্যতা চেয়েছে, সভ্যতা চেয়েছে, মানুষের মত হয়ে বাঁচতে চেয়েছে। সুবৰ্ণলতা বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে নাড়ীর যোগ রাখতে চেয়েছে, দেশের কথা ভাবতে চেয়েছে, দেশের পরাধীনতার অবসান চেয়েছে।
সুবৰ্ণলতাকে তবে পাগল বলবে না কেন তার স্বামী, শাশুড়ী, ভাসুর, দ্যাওর?
ওরা বলেছে, বাবার জন্মে শুনি নি এমন কথা! বলেছে, সেই যে বলে সুখে থাকতে ভূতের কিল খাওয়া, মেজবৌয়ের হচ্ছে তাই! রাতদিন অকারণ অসন্তোষ, রাতদিন অকারণ আক্ষেপ!
ওরা সুবৰ্ণলতার ওই চাহিদাটাকে অকারণ অসন্তোষ ছাড়া আর কোনো অ্যাখ্যা দেয় নি। ওদের বোধের জগৎটা ওদের তৈরী বাড়ির ঘরের মত। কোথাও•এমন একটা ভেন্টিলেটার নেই যেখান দিয়ে চলমান বাতাসের এক কণা ঢুকে পূড়তে পারে।
দর্জিপাড়ার এই গলিটার বাইরে আর কোনো জগৎ আছে, এ ওরা শুধু জানে না তা নয় মানতেও রাজী নয়।
ঘর বানবার সময় আওয়াজী (ভেন্টিলেটার) না রাখার যুক্তিটাই ওদের মনোভাব।
কোনো দরকার নেই। অনর্থক দেয়ালটায় ফুটো রাখা। পাখীতে বাসা বানাবে, আর জঞ্জাল জড়ো হবে, এই তো লাভ?
অনর্থক পাখীর বাসায় জঞ্জাল জড়ো করতে চায় নি। ওরা। তাতে শুধু লোকসানই দেখেছে।
ওদের বোধের ঘরেও ভেন্টিলেটারের অভাব।
কিন্তু সুবৰ্ণলতা কেন বহির্জগতে বহমান বাতাসের স্পর্শ চায়? এ বাড়ির বৌ হয়েও তার সমস্ত সত্তা কেন মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় ছট্ফট করে? তার পরিবেশ কেন অহরহ তাকে পীড়া দেয়, আঘাত হানে?
তা এ প্রশ্নের উত্তর একদা সুবৰ্ণলতার বিধাতাও চেয়ে পান নি।
যেদিন আসন্ন সন্ধ্যার মুখে সুবৰ্ণলতার শেষ চিহ্নটুকু পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে গেল, চিতার আগুনের লাল আভায় আকাশের লাল আভায় মিশলো, ধোঁয়া আর আগুনের লুকোচুরির মাঝখান থেকে সুবৰ্ণলতা পরলোকে পৌঁছে গেলেন, সেদিন যখন চিত্রগুপ্তের অফিসে নতুন কেউ এসে পড়ায় ঘন্টিটা বেজে উঠল, বিধাতা-পুরুষ গলাঝাড়া দিয়ে বললেন, কে এল হে চিত্ৰগুপ্ত?
চিত্ৰগুপ্ত গলাঝাড়া দিয়ে বলে উঠলেন, আজ্ঞে হুজুর, সুবৰ্ণলতা।
সুবৰ্ণলতা? কোন সুবৰ্ণলতা? কাদের ঘরের?
আজ্ঞে হুজুর বামুনদের। যে মেয়েটা সেই পনেরো বছর বয়ে থেকে মরণকামনা করতে করতে এই পঞ্চাশ বছরে সত্যি মালো!
বিধাতাপুরুষ বললেন, তাই নাকি? তা জীবনভোর মরণকামনা কেন? খুব দুঃখী ছিল বুঝি?