কিন্তু পায়ের মল কি এক সুবৰ্ণই খুলেছিল? তা যেই খুলুক প্ৰবোধের সেটা জানার কথা নয়, প্ৰবোধ তাই প্রতি মুহূর্তে একটি মলের রুনুকুনুর অপেক্ষায় উৎকৰ্ণ হয়ে হয়ে ক্রমশ হতাশ হচ্ছে, ক্রুদ্ধ হচ্ছে, ক্ষিপ্ত হচ্ছে।
গরমে গলাগলিয়ে ঘাম ঝরছে, মশার কামড়ে আরো গা ফুলে উঠেছে, নিজের হাতের চড় খেয়ে খেয়ে গায়ে ব্যথা হবার যোগাড়! তবু বেরিয়ে পড়বার উপায় নেই। কারণ আশা ছলনাময়ী। তা ছাড়া বেরোবেই বা কোন লজ্জায়? ও যে আজ অফিস পালিয়েছে সেটা তো আর ঢাক পিটিয়ে লোক-জানাজানি করবার কথা নয়।
অফিস পালানো বলে পালানো, প্রায় ছেলেবেলায় স্কুল পালানোর মতই কাণ্ড করে বসেছে। দাদার সঙ্গে পাশাপাশি বসে ভাত খেয়ে, দাদার সঙ্গে একসঙ্গে বেরিয়ে, দাদার চোখে ধুলো দিয়ে ফিরে এসেছে। ধুলো দেওয়ার সুবিধেও আছে, প্ৰবোধ যায় ট্রামে, সুবোধ যায় শেয়ারের ঘোড়ার গাড়িতে। মোড়ের মাথায় ছাড়াছাড়ি হয়ই।
দাদাকে দেখিয়ে ট্রামে উঠে, একটু পরে টুপ করে নেমে আসে গুটি গুটি বাড়িপানে। এ সময় কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার ভয় কম, কারণ পাড়া ঝেটিয়েই তো সব পুরুষ জাতীয়েরা অফিস ইস্কুলে চলে গেছে। মেয়েমানুষরা তো আর রাস্তায় বেরোচ্ছে না যে দেখে ফেলবে?
তবু যদি কারো বাড়ির ঝি-চাকর কি স্বয়ং খুদুর সঙ্গেই দেখা হয়ে যায়, কোন কথাটা বলে মান রক্ষা করবে, সেটা তৈরি করেই রেখেছে! বলবে, ওরে বাবারে, পেটের মধ্যেটা এমন মোচড় দিয়ে উঠল, মাঝপথে ফিরে আসতে হল।
না, এর থেকে সভ্য কোনো মিথ্যে কথা বানাতে পারে নি। সুবৰ্ণলতার স্বামী। কিন্তু বিধি তখনও পর্যন্ত তার প্রতি সদয়। তাই কোনো চেনা মুখের সঙ্গে মুখোমুখি হতে হল না প্ৰবোধচন্দ্ৰকে। অবশ্যি সদর দোর দিয়েও ঢোকে নি সে। কি জানি দৈবদুর্বিপাকে যদি আজই মুক্তকেশী। এত বেলায়?ष्ठाङ्क्षाgনা याনা!
হ্যাঁ, নিত্য গঙ্গাস্নানের পুণ্য অর্জন করে চলেছেন মুক্তকেশী বিধবা হয়ে পর্যন্ত। বিরাজ তখনো নিতান্ত শিশু, তত্ৰাচ মুক্তকেশী বৈধব্য ঘটবার সঙ্গে সঙ্গেই বৈধব্যের সর্ববিধ শুচিতা এবং কঠোরতা পালন করে আসছেন। চুল কেটেছেন, হাত শুধু করেছেন, পান ছেড়েছেন রাত্রে আচমনী খাদ্য ছেড়েছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
ছেলেদের অফিস পাঠিয়ে মুক্তকেশী ঘটি-গামছা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সে আন্দাজে বেরিয়ে গেছেন, কিন্তু কে বলতে পারে প্রবোধের ভাগ্যেই আজ–
পাশের ওই মেথর আসার গলি দিয়ে ঢুকে পড়লে আর কোনো ভয় নাই। মুক্তকেশী এর ধারেকাছেও উঁকি দেন না কোনোদিন। প্ৰবোধ? সে তো আড়াই পা বাড়ালেই শুদ্ধ। আড়াই পায়ের কসরৎ ছেলেবেলা থেকেই অভ্যাস করা আছে মুক্তকেশীর ছেলেদের।
অতএব প্ৰবোধ নিষ্কন্টকে বাড়ি ঢুকে এদিকে ওদিক তাকিয়ে ঝাঁপ করে ছাতের সিঁড়ি ধরেছে। ধরেছে মানেই মরেছে। সেই বোলা এগারটা থেকে এই বেলা আড়াইটে! চিলেকোঠার এই ঘরটাতেই কি জমাতে হয়। ছাই সংসারের যাবতীয় ওঁচা মাল?
পায়াভাঙা চৌকী, কলাভাঙা তোরঙ্গ, ড্রালাভাঙা হাতবাক্স, এসব ছাড়াও ছেঁড়া মশারি, পুরানো কাঁথা, বাতিল তোশক, ফুটো ঘড়া, কাচফাটা ছবির ফ্ৰেম-কী আছে আর কী নেই! ফেলবার নয়, ফেলবার নয়, এই সব বস্তুর আর গতিই বা কি?
অবশ্য ভবিষ্যতে ওদের আবার টেনেন্টুনে কাজে লাগাবার আশা আছেও কিছু কিছু। যেমন, সময় সুবিধে করে ধুনুরি ডেকে ছেঁড়া তোশক ধুনিয়ে, নতুন একটু খেরো কিনে তোশক বানিয়ে নেওয়া, কাঁথাগুলোর উপর আবার একপ্রস্থ করে কাপড় বসিয়ে গোটাকতক ফোঁড় চালিয়ে নিয়ে কাজ চালানো, বাসনওলা এলে ঘাড়াগুলো বদল দেওয়া, আর বাসনওয়ালী এলে ছেঁড়া মশারি বদলে দুএকখানা পাথরের খোরা, কি কাসার বাটি, নয়তো একটা পেতলের গামলা কি মোটা চিরুনি আর হাত-আয়না কিনে ফেলা!
ফাটা ছবির ফ্রেমেরও সদৃগতি হয় বৈকি! ভাঙা কাঁচেরও খদের আছে। ভরদুপুরে বেরোয় তারা কাচ ভাঙা-কাচ ভাঙা হাঁক পেড়ে। চোর সামলাতে পাঁচিলের মাথায় ভাঙা কাচ পুততে কেনা হয় ওগুলো।
মোটা কথা, গোরস্ত বাড়িতে চাটু করে কিছু ফেলে দেওয়ার কথা ওঠে না। ফেলাছড়ায় মা-লক্ষ্মী বিমুখ হন এ আর কোন গোরস্তর গিন্নী না জানে? অথচ ওই সব কুদর্শন বস্তুগুলো, সময়সাপেক্ষে যাদের সদগতি হবে, তাদের কিছু আর সর্বদা চোখের সামনে বিছিয়ে রাখা যায় না! তাদের জন্যেই চোরকুঠুরি, চিলেকোটা, চালি, সাঙ্গা!
মুক্তকেশী ও গোরস্তর পিানীর পদ্ধতিতেই চিলেকোঠাটাকে বোঝাই করে রেখেছেন। কোনো একদিনও এ ঘরে আর আদরে পুত্ররত্ব পেবো এসে বসে বসে মশার কামড় খাবে আর নিজের গাল নিজে চড়াবে, এ কথা মুক্তকেশীর স্বপ্নের অগোচর।
অথচ সেটাই ঘটছে।
পেবো মশার ছুতোয় নিজের গালে নিজে চড়াচ্ছে, নিজের কান নিজে মুলছে, এবং নেহাৎ মাটিতে শতবর্ষের ধুলো বলে নাক ঘষটে নাকে খৎ দিতে না পারায় মনে মনে সেটা দিচ্ছে শতবার!
ভরসা বলতে, আশ্রয় বলতে ভাঙা এই তক্তপোশটা। সেটাকে প্ৰবোধ ফুঁ দিয়ে দিয়ে আলতো করে কোঁচার আগার ঝাঁপটা মেরে বসবার যোগ্য করে নিয়েছে। সুবৰ্ণলতাকে নিয়ে যদি দুদণ্ড বসতে হয় এখানে বিরহজ্বালা মেটাতে, চৌকির ক্যাচার্ক্যোচ শব্দটা নিয়ে না মুশকিলে পড়তে হয়, এই ভাবনাতেই কাতর ছিল প্রথম দিকে, ক্রমশ সেটা চলে গেছে, এখন শুধু ভাবনা সুবর্ণ এলে কী কী কটু কথায় মনের ঝাল মেটাবে।
কী ভেবেছে সে নিজেকে?
মহারাণী?
তাই তীর্থের কাকের মতন, রাস্তার হ্যাংলা কুকুরের মতন হা-পিত্যেশ করে বসে আছে প্ৰবোধ, যে নাকি সুবর্ণর স্বামী! জগতের সেরা গুরুজন! জাপান থেকে চিরুনি আসে, তাতে পর্যন্ত লেখা থাকে পতি পরম গুরু। তার মানে তাদের দশের মেয়েরাও এ উপদেশ শিরোধাৰ্য করে। আর সুবর্ণ হিন্দুর মেয়ে হয়ে, বাঙালীর মেয়ে হয়ে এই কষ্টটা দিচ্ছে স্বামীকে?