কিন্তু প্ৰবোধ থাকলে দাদার বদলে ছোট ভাইদের সমর্থন করে। বলে, দিয়ে আসতে হবে একদিন বিদেয় করে।
বলে, তবে গলাটা একটু নামিয়ে বলে। বৌকে নেহাৎ চটিয়ে রাখলে অসুবিধে আছে। বৌ বিগড়োলে নিজের স্বভাব-চরিত্র ভাল রাখতে পারা যাবে কি বিগড়ে বসবে কে বলতে পারে? পুরুষমানুষ তো?
বাদুড়বাগানে মুক্তকেশীর সমবয়সী মাসতুতো বোন হেমাঙ্গিনীর বাড়ি। মাথা গরম হয়ে উঠলেই এখানে চলে আসেন মুক্তকেশী। কারণ হেমার কথাবার্তা প্ৰাণ-জুড়োনো, হেমার কাছে জল উঁচু তো জল উঁচু , জল নীচু তো জল নীচু।
মুক্তকেশী যদি বলেন, আমার বড় বেঁটার মত ভালোমানুষ আর হয় না—
হেমা বলেন, আহা তা আর বলতে! বৌ দেখলে চোখ জুড়োয়।
মুক্তকেশী যদি বলেন, আমার বড় বেঁটার মতন বোকা আর ত্ৰিভুবনে নেই-
হেমা বলেন, তা যা বলেছ, দেখছি তো সব! তুই যাই তাই-ওই বোকাকে নিয়ে ঘর করছিস!
তবে মুক্তকেশীর মেজ বৌ সম্পর্কে সুরফের্তা করতে হয় না কখনো হেমাকে। সব সময়েই বলা চলে, সত্যি মুক্ত, কী করে যে তুই বৌ নিয়ে ঘর করছিস!
মুক্তকেশী কপালে করাঘাত করে বলেন, উপায়? পেবোর তো শুধু মুখে হুমকি, ভেতরে ভেতরে রূপুসী বৌয়ের ছিচরণের গোলাম! আমার অবস্থাটি কেমন? সেই যে বলে না—
মেয়ে বিয়োলাম, জামাইকে দিলাম
বেটা বিয়োলাম, বৌকে দিলাম,
আপনি হলাম বাঁদী,
ইচ্ছে হয় যে, দুয়োরে বসে
ঠ্যাং ছড়িয়ে কাঁদি!
সেই তাই, চোর হয়ে আছি।
সমবয়সী হলেও মুক্ত নাকি দু-চার মাসের ছোট, তাই হেমাঙ্গিনীর বর কাশীনাথ তাঁর সঙ্গে ছোট শালীজনোচিত কৌতুক-পরিহাস করে থাকেন, এবং দুই বোনে একত্র হলেই ঠিক এসে জোটেন। ভাল চাকরি করতেন, দিল্লী-সিমলেয় কাজ ছিল, সম্প্রতি রিটায়ার করে সাবেকী বাড়িতে এসে বসবাস করছেন। হেমাঙ্গিনী অবশ্য কখনো স্বামীর সঙ্গে সেই দিল্লী-সিমলের সুখাস্বাদন করতে যান নি। বরের সঙ্গে বাসায় যাওয়ার নিন্দের ভয়েই শুধু নয়, নিজের দিকেও জাত-যাওয়ার ভয় ছিল প্ৰবল। ওসব দেশে গেলে যে জাত-যাওয়া অনিবাৰ্য এ কথা হেমাঙ্গিনীর ছেলেবেলা থেকে শোনা। কাশীনাথের গৃহসুখ ছিল শুধু ছুটি-ছাটায়।–
কাশীনাথ হেসে হেসে বলতেন, জাতটা আর বাঁচলো কই? এই জাত-যাওয়া লোকটার ঘরে এসে তো শুচছ!
হেমাঙ্গিনী ভ্ৰাভঙ্গী করত, যত সব বিটকেল কথা!
আমি চলে গেলে গঙ্গাস্নান করা? না শুধু লুকিয়ে একটু গোবর খেয়ে ফেল?
হেমাঙ্গিনী আরো ভুরু কোঁচকাতো।
বেশি কথা বলতে জানতো না কখনো, এখনো না। সব কথাই মুক্তকেশীর। মাঝে-সাঝে কাশীনাথ এসে জোটেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মত।
তুমি চোর হয়ে আছ? বল কি মুক্ত? তা হলে ডাকাত আবার কেমন দেখতে?
হেমাঙ্গিনী বলে ওঠেন, আবার তুমি মস্করা করতে এলে? ও মরছে নিজের জ্বালায়—
কাশীনাথ হুঁকো খেতে খেতে মিটিমিটি হেসে বলেন, লঙ্কাও মরে নিজের জ্বালায়। তার জুলুনি ঘোচাবে, এমন সাধ্যি মা গঙ্গারও নেই! বলি, হচ্ছে তো? পরের মেয়েদের কুচ্ছে হচ্ছে তো? আশ্চয্যি, বুড়ো বুড়ো দুটো গিন্নী তোমরা, আপনি আপন দোষ দেখতে পাও না, ওই দুধের মেয়েগুলোও মধ্যে এত দোষও দেখো!
মুক্তকেশীর মুখ লাল হয়ে ওঠে, তবু বলেন, বুড়ো মাগীদের দোষ দেখতে তো জগৎ আছে জামাইবাবু! এই তুমিই তো কত দোষ দেখছা! তবে ওদেরও শিক্ষেদীক্ষের দরকার। কুচ্ছে। আমরা করি না, হক কথা বলি। এই যেমন তোমাদের ঘরের ছোটটি, তেমনি আমার ঘরের মেজটি, তুল্যমূল্য। ওরা আমাদের দেশত্যাগী করতে পারবে।
তা বললে কী হবে? হেমাঙ্গিনী অসন্তোয্যের গলায় বলেন, বুড়ো বয়সে উনি এখন ক্ষুদে ক্ষুদে বৌদের মানরাখা কথা বলতে আরম্ভ করেছেন! মনে করেছেন তাতে রাখি! আমি মরে গেলে বৌরা যত্ন-আত্তি করবে! মনেও করো না তা, বুঝলে? বাঘিনীর চোখের সামনে আছে, তাই এখন এত ঠাকুরসেবা। মারি একবার, তখন দেখো। বলবে ভাল আপদ হয়েছে, ঘাড়ে একটা বুড়ো শ্বশুর!
কাশীনাথ হেসে ওঠেন, বালাই বালাই, তুমি মরবে। আর আমি জিন্দা থেকে সেই দৃশ্য দেখবো? ছিঃ! তুমি দু-দশ দিন মুক্তর মতন মাথা মুড়িয়ে হাত নেড়া করে স্বাধীনতার সুখটা ভোগ করে নাও। বৈধব্যকালটাই তো মেয়েমানুষের আসল সুখের কাল গো! তাতে আবার যদি বয়েসকলটা একটু ভাটিয়ে আসে! কার সাধ্যি হক কথা বলে!
জামাইবাবুর। যেমন কথা!
মুক্তকেশী কোপ প্ৰকাশ করেন।
কাশীনাথ দামেন না। বলেন, হক্ কথা কও ভাই মুক্ত, ভায়রাভাই যখন বেঁচে ছিল এত পা ছিল তোমার? এত স্বাধীনতা?
এইরকম হাড়জুলানো কথাবার্তা কাশীনাথের। কিন্তু শুনতেই হয়, উপায় কি? হেমা যে তার প্ৰাণের সখী, হেমার সঙ্গেই যত শলা-পরামর্শ। শিষ্যাও বটে।
বৌদের কিসে জব্দ রাখতে হয়, আর ছেলেদের কি করে বশে রাখতে হয়, সে বিদ্যাকৌশল মুক্তকেশী শেখান হেমাঙ্গিনীকে।
আজ কিন্তু মুক্তকেশীই পরামর্শ চান, ওই বেহেড বৌকে কি করে দাবে আনি বল দিকি হেমা?
হেমাঙ্গিনীরও বোধ করি। হঠাৎ গুরুর পোস্ট পেয়ে বুদ্ধি খুলে যায়। গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলেন, দাবে আনা যায় ভাতে মারলে! বরের সোহাগেই তো ধরাখানা সরাখানা। তুমি একটা কোনো কৌশল করে ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে শোবে, দেখো দুদিনে টিট হয়ে যাবে।
মুক্তকেশীর কৌশলটা মনঃপুত হয়, কিন্তু সম্ভব মনে হয় না। বলেন, ছোঁড়া যে তা হলে বুক ফেটে মরবো!
বরং উল্টো রে মুক্ত, ডাকিনীদের খপ্পর থেকে দুদিন সরিয়ে নিয়ে বাঁচবে। তুই একটা বানানো কথা বল। বল যে স্বপ্ন দেখলাম, তোর সময় খারাপ আসছে। মাতৃমন্তর জপিলে আর মায়ের আওতায় থাকলে তবেই রক্ষে।