তবু আবার দুপুরবেলা উত্তরাকে এ ঘরের দরজায় এসে বলতে হয়, বাবা, তরকারি মুখে ভাল লাগল?
প্রিয়মাধব বলেন, অপূর্ব! তুমি নিজে বেঁধেছ বুঝি?
নীহার বলত, আমার কিন্তু ভারী ইন্টারেস্টিং লাগে। এত রোগী দেখেছি, এমন মজার রোগী দেখিনি কখনও।
আপনার আর মজা লাগবে না কেন?উত্তরা ভারী গলায় বলত, আপনার তো জীবন ফসিলহয়ে যাচ্ছে না আমার মতো? বিয়ে হয়ে পর্যন্ত এই দৃশ্য ২৪৬
অরুণমাধব ক্ষুব্ধ হত, অরুণমাধব লজ্জিত হত। ক্ষুব্ধ হত স্ত্রীর মনোভাবে, লজ্জিত হত বাবার ব্যবহারে।
উত্তরার কাছে অরুণমাধবের মুখরক্ষা করতেও যদি বাবা। শুনেছিল মৃত্যু অনিবার্য, প্রিয়মাধবের ব্যাপারে কি তার ব্যতিক্রম হবে?
.
আশা ফুরিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এল একদিন সেই অনিবার্য!
এল, কিন্তু ঢাকঢোল বাজিয়ে সমারোহ করে নয়, নিঃশব্দে।
হয়তো অনেক ঢাকঢোল বাজিয়ে নিয়েছে বলেই এখন স্তব্ধতা পছন্দ করল।
অনেক রাত্রে নীহার এসে এ ঘরের দরজায় টোকা দিল। বলল, আসুন?
এ কী সুর!
এ কী ভঙ্গি।
অরুণমাধব শুকনো গলায় বলল, কী হয়েছে?
ঘামছেন!
উত্তরা মৃতের মতো বলল, পাখা খুলে দেননি?
নীহার একটু হেসে বলল, দিয়েছি।
অরুণমাধব ত্রস্ত হয়ে জামা গায়ে দিতে গেল। নীহার বলল, ও কী করছেন?
ডাক্তারকে বলিগে—
আর নয়, থাক। ডাক্তার এসে পৌঁছবে না।
তা হলে?
আসুন এ-ঘরে।
অরুণ গেল, উত্তরাও গেল।
নিঃসন্তান দম্পতি, পিছনের দিকে তাকাতে হয় না।
প্রিয়মাধব ঘামছিলেন।
কবিরাজরা নাকি একেই বলেন কালঘাম। তবু প্রিয়মাধবের জ্ঞান চলে যায়নি। প্রিয়মাধব স্পষ্ট করে তাকাতে পারছিলেন না, কিন্তু স্পষ্ট গলায় কথা বলেছিলেন, কোথায় ছিলে তোমরা? সারারাত একলা পড়ে আছি আমি।
অরুণমাধব ঝুঁকে পড়ে ডেকে বলে ওঠে, বাবা, কী কষ্ট হচ্ছে?
প্রিয়মাধব বললেন, মরতে পারছি না, এই কষ্ট।
বাবা, ডাক্তারবাবুকে ডাকব?
আঃ।
ধমক দিয়ে উঠলেন প্রিয়মাধব।
তারপর বলে উঠলেন, অরুণ, আমাকে সে কথা বলতেই হবে। নইলে মরা হবে না।
উত্তরা এগিয়ে এসে বলল, কোন কথা বাবা?
প্রিয়মাধব এই মরণকালেও চেঁচিয়ে উঠলেন। বললেন, আঃ, তুমি কে বাঁচাল মেয়ে? যাও, যাও এ ঘর থেকে।
উত্তরা ঠিকরে বেরিয়ে গেল।
নীহার ওদিক থেকে একটু অনুকম্পার হাসি হাসল।
প্রিয়মাধব আরও ঘামছিলেন, নীহার মুছিয়ে দিচ্ছিল তোয়ালে দিয়ে। নীহার জানতে পারছিল, এই ফরসা তোয়ালেটা কাল সকালে আর পালঙ্কের বাজুতে পাট করে রাখতে হবে না।
প্রিয়মাধব বললেন, নার্স, তুমি যাও।
না, আমি যাব না।
প্রিয়মাধব তেড়ে উঠলেন, তুমি আমার গোপন কথা শুনবে?
শুনতেই হবে।
অরুণ, একে তাড়িয়ে দাও।
অরুণ মিনতির চোখে তাকাল। নীহার নিচু গলায় বলল, অনেকক্ষণ থেকে ডিলিরিয়াম শুরু হয়ে গেছে। অনেক গোপন কথা বলেছেন আমায়।
অরুণ স্তিমিত হয়ে গেল।
প্রিয়মাধবও স্তিমিত হয়ে যাচ্ছেন, তবু শেষ চেষ্টা করলেন প্রিয়মাধব, এই চাবিটা নাও। ওটা খোলো।
সেই চাবি, যা এতদিন আগলে রেখেছিলেন প্রিয়মাধব।
অরুণের হাত-পা শিথিল হয়ে যাচ্ছিল, তবু অরুণ খুলল গডরেজের ছোট্ট আলমারিটা। কিছু নেই, শুধু কিছু কাগজ আর একটা মোটা খাতা!
মূঢ়ের মতো তাকাল।
প্রিয়মাধব বিছানা হাতড়াচ্ছিলেন, যেন কিছু একটা খুঁজছিলেন।
অরুণমাধব শুকনো গলায় বলে, বাবা, কী দেব?
প্রিয়মাধব শুনতে পেলেন না। নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, তোমার চোখ সরাও। দেয়ালে, ছাতে, জানলায়, দরজায় সব জায়গায় চোখ পেতে রাখবে কেন তুমি? বুঝতে পারো না আমার ভয় করে? কত মায়া ছিল তোমার, এত নিষ্ঠুর হলে কী করে?
মুমূর্ষ রোগীর প্রলাপের মধ্যে কি কোনও অর্থ থাকে? বাক্যন্ত্রের আর চিন্তার যন্ত্রের মধ্যেকার যোগসূত্র তো ছিন্ন হয়ে গেছে, ভেঙে পড়ে গেছে চলাচলের সেতু। এখন তো শুধু চির-অভ্যস্ত বাকযন্ত্র এলোমেলো করে ছড়িয়ে দিচ্ছে তার শেষ শক্তিটুকু।
অরুণ তবে কেন সেই অর্থহীন প্রলাপের মধ্যে থেকে অর্থ খুঁজতে চাইছে? ও কেন উৎকর্ণ হয়ে ওই কথাগুলোই শুনছে?…প্রিয়মাধবের নখের ডগাগুলো যে অসম্ভব ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, নীহার যে যেখানে যত ভোয়ালে ছিল সব দিয়েও প্রিয়মাধবের ঘাম মুছিয়ে শেষ করতে পারছে না, এ কি প্রিয়মাধবের ছেলের চোখে পড়ছে না?
তাই অজানিত এক রহস্যলোকের বন্ধ দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকার মতো দাঁড়িয়ে আছে সে ওই প্রলাপোক্তির সামনে।
হয়তো এমনিই হয়।
একা অরুণমাধবই নয়, মানুষ মাত্রেই রোগীর প্রলাপোক্তির মধ্যে থেকে, মুমূর্যর শেষোক্তির মধ্যে থেকে কোনও এক অজানা রহস্যলোকের চাবি খুঁজতে বসে।
চিরদিন দরজায় দরজায় পাহারাদার ছিল মোতায়েন, আগলে রাখত রহস্যের কোষাগার, আজ পরিত্যাগ করে চলে গেল তারা ভগ্নদুর্গ। খোলা পড়ে রইল দরজা। কৌতূহলী মানুষেরা তবে উঁকি মেরে দেখতে আসবে না কেন, কী ছিল ওখানে? ঝড়তি-পড়তি যদি কিছু পড়ে থাকে, কুড়িয়ে নিতে পারলে তো বোঝা যাবে, কোন রহস্যপুরীর দরজা আগলে থাকত মজবুত পাহারাদার! অরুণও সব মানুষের মতোই করল।
কান পাতল ওই স্তিমিত কণ্ঠের অর্থহীন প্রলাপোক্তিতে।
স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে..ক্রমশ স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে সেই অর্থহীন বিড়বিড় করা বকুনি। যেন সরু তারের উপর দিয়ে হাঁটছে, আর বারেবারে পা ফসকে যাচ্ছে। তবু চোখ রাঙাচ্ছ? কতবার বলছি, তোমার ছেলে ভয় পাবে। হ্যাঁ হ্যাঁ–ছেলে।…আঃ, কী নাম তোমার? জানো না? থাক থাক্, বলতে হবে না। শুধু শুনে রাখো, সুমিতা তোমার মা নয়!… না-না, ভুল বলছি ছেলে, সুমিতা তোমার মা। বুঝলে? শুনতে পাচ্ছ, সুমিতা তোমার মা, কিন্তু সে তো হারিয়ে গেছে। সেই যখন তুমি একটা খোকা ছিলে, তখন