নীহারের এই অসীম বিবেচনায় উত্তরা ওকে নার্স বলে দূরে রাখেনি, আত্মীয়ের মতো ভাবে।
.
সুমিতা মারা যেতে উত্তরার মা বেয়াইকে ডেকেও বলেছিলেন, দেখুন বেয়াই মশাই, ভাল করে তাকিয়ে দেখুন, আর তো দেখতে পাবেন না। একদিন নিজে হাতে করে মাথায় সিঁদুর ঢেলে দিয়ে আঁচলে আঁচলে বেঁধে এই ঘরে নিয়ে এসেছিলেন, আজ সেই গাঁটছড়া খুলে দিয়ে নতুন সাজে সেজে চলে যাচ্ছেন বেয়ান।
ভদ্রমহিলার বুকের পাটা যে বিলক্ষণ তা বোঝা গেল। অরুণ চমকে উঠল–এই একটা ঝড় ওঠে বুঝি। এই গ্রাম্যতায় না জানি কী তীব্র ব্যঙ্গ করে উঠবেন বাবা!
প্রিয়মাধব কিন্তু ঝড় ওঠালেন না, নিঃসাড় হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বোধ-চৈতন্য কিছু আছে, তা বোধ হল না।
অরুণমাধবের শাশুড়ি তাঁর বেয়াইয়ের বোধ-চৈতন্য উদ্রেকের উদ্দেশ্যে আরও বেশ কিছু হৃদয় মোচড়ানো কথা বললেন, কাজে লাগল না। প্রিয়মাধব পাথরের মতো শুয়ে রইলেন, সুমিতার দিকে না তাকিয়ে।
ভদ্রমহিলা এ-ঘরে এসে বললেন, তোর শ্বশুরের ব্রেনটা একেবারে গেছে উত্তরা, নইলে এতকালের সঙ্গী চিরকালের মতো চলে যাচ্ছে, চোখে এক ফোঁটা জল নেই? এক বিন্দু আকুলতা নেই? পাগলেও এমন শোক বুঝতে পারে।
উত্তরাও অবাক হচ্ছিল বইকী!
ও তো ভেবেছিল শ্বশুরকে ধরে রাখা যাবে না, হুড়মুড়িয়ে উঠতে চেষ্টা করে পড়ে প্রাণটা হারাবেন। কিন্তু সে-দৃশ্য দেখল না। প্রিয়মাধব পাথর হয়ে রইলেন। একদণ্ড চোখের আড়াল হলে সুমিতা সুমিতা করে ডাক পাড়তেন। সুমিতা চলে গেলেন, একবারের জন্যে ডাকলেন না প্রিয়মাধব সুমিতা বলে। একবিন্দু জল গড়াল না।
ব্রেনটা কি তবে হঠাৎ শ পেয়ে অকেজো হয়ে গেল?
তাই মনে হয়েছিল কদিন।
যে কদিন অরুণমাধব, উত্তরা আর বাড়ির চাকরটা মিলে এলোমেলো করে সেবা করেছিল, পাথরের মতো পড়ে ছিলেন প্রিয়মাধব।
কিন্তু নার্স ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে যেন ছিটকে উঠলেন, বদলে গেলেন। নাওয়া খাওয়া প্রত্যেকটি ব্যাপারে রসাতল করতে লাগলেন। চামচখানা রাখা, কি তোয়ালেখানা পাট করার অপরিপাট্য নিয়ে অভিযোগের ঝড় তুলতে লাগলেন। আর শুরু করলেন তীব্র তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গবচন।
একদিন তো উত্তরা বলেই ফেলেছিল, তা ঠিক, মার মতন আর কে হবে বাবা? আপনি যদি তেমন আশা করেন ।
প্রিয়মাধব বলেছিলেন, কথা বলতেও শিখতে হয় বউমা! ওটা শিখতে তোমার বাকি আছে।
কিন্তু মাঝে মাঝে অবস্থার বদল হয়। অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকেন প্রিয়মাধব। মৃত্যুর পদধ্বনি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঘণ্টা মিনিট মাপা হয়। উত্তরা মুক্তির স্বপ্ন দেখে, অরুণ দিশেহারা হয়।
বাবা থাকবেন না, এখনও যেন এ কথা ভাবতে পারে না অরুণমাধব। তেরো বছর ধরে প্রায় শিলীভূত হয়ে পড়ে আছেন প্রিয়মাধব–তবুও। অরুণমাধবের চেতনার কাল থেকেই বাবাই তার
জীবনের হিরো। চা বাগানের সেই প্রাণহীন পরিবেশের মধ্যে বাবাকে মনে হত প্রাণের বন্যা।
মা ছিলেন একটু মৃদু, একটু চুপচাপ।
বাবা উত্তাল, অস্থির, দুরন্ত।
সেই বাবার এই পরিণতি বড় বিচলিত করে রেখেছে অরুণমাধবকে।
তবু ইদানীং অনিবার্যের নৈবেদ্য হাতে করেই বসে থাকতে হচ্ছে।
প্রায়ই সেই অনিবার্য জানান দিচ্ছে। প্রায়ই আজকাল সকালে এ ঘরে এদের সঙ্গে চা খেতে বসে নীহার বলে, আজ সকালে আবার এ দৃশ্য দেখাতে পারব আপনাদের, এ আশা করিনিকাল রাত্রে যা অবস্থা!
অরুণমাধব শিউরে উঠে বলে, সে কী, ডাকেননি কেন আমাদের?
নীহার বলে, উঁহু! আরও না দেখে
অরুণ বলে, শেষকালে বাবার যদি কিছু বলতে ইচ্ছে করে!
এত অগাধ সময় পেয়েও যদি সে ইচ্ছে মিটিয়ে নিতে না পারেন, না-ই পারলেন।
কথা আর কি! কোন কথা বলবার থাকতে পারে? তবে
উত্তরা ভাবত ওই লকারটায় না জানি কী আছে! এখনও শ্বশুর যার চাবি আগলাচ্ছেন। ওইটার কথাই হয়তো কিছু বলবেন। হয়তো কোনও দলিলপত্র আছে। হয়তো শাশুড়ির গয়নাগাঁটি আছে। সেইগুলো হাতে তুলে দেবেন আনুষ্ঠানিক ভাবে। কিন্তু সে অনুষ্ঠানে দরকার কী?…ভাবত উত্তরা, মারা গেলে তো আর চাবি সামলাতে আসবেন না প্রিয়মাধব?…আর সে চাবির ভাগীদারও কেউ নেই একা অরুণ ছাড়া।
প্রিয়মাধবের মাথার কাছের বাজুতে একখানা পাটকরা তোয়ালে, প্রিয়মাধবের সামনে একটা নিচু গোল টেবিল, যাতে থরে থরে সাজানো আছে শিশি, বোতল, কৌটো।…
যেন এই দৃশ্যটাই অনিবার্য!
উত্তরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত ওই দৃশ্যটার উপর। উত্তরা যে তার বরের সঙ্গে একদিনের জন্যে কোথাও বেড়াতে যেতে পারেনি, এ আক্ষেপ করতেও ভুলে যাচ্ছিল ক্রমশ।
ও জানে ওকে সকালবেলা উঠেই এ ঘরে এসে বলতে হবে, বাবা কেমন আছেন?
প্রিয়মাধব এক টুকরো বিদ্রুপের হাসি হেসে বলবেন, চমৎকার!
একটুক্ষণ অপ্রতিভের মতো দাঁড়িয়ে থেকে সরে আসতে হবে উত্তরাকে! বেশিক্ষণ কাউকে সহ্য করেন না প্রিয়মাধব। বাড়ির লোক কি অন্য আত্মীয় কেউ এসে একটু বেশিক্ষণ দাঁড়ালেই প্রিয়মাধব বলে ওঠেন, আর কেন? হয়ে গেছে তো চারপেয়ে গোরু দেখা।! টিকিট উসুল হয়ে গেছে। এবার যেতে পারো।
উত্তরা বলত, আর আমি যাব না ও ঘরে।
অরুণমাধব বলত, বাবাকে কি এখন পুরো মানুষ ভাবা উচিত উত্তরা?
উত্তরা রেগে উঠত। বলত, পুরো মানুষের মানমর্যাদা, প্রাপ্য পাওনাটা তো পুরোর উপর আরও বেশি নিচ্ছেন। তাতে তো একতিল ঔদাসীন্য দেখি না!