কিন্তু এই নায়িকাদের বধ করতে হবে নীহারকে।
নীহার যাঁর মাইনে খেয়েছিল, সেই প্রিয়মাধবের আদেশ পালন করতে হবে তাকে। নমিতা নামের ওই নায়িকাটি পৃথিবী থেকে মুছে যাবে? যাক না!
ক্ষতি কী?
গিয়েই তো ছিল।
নতুন করে আবার উদঘাটন করে লাভ কী? সত্যি খবর জেনে অরুণমাধব তার সত্যি মাকে খুঁজে বেড়াবে?
তিরিশ বছর ধরে কি সত্যিই টিকে আছেন তিনি এই পৃথিবীতে? যদি থাকেন, ছমাসের যে ছেলেটাকে ফেলে রেখে গিয়েছিলেন তিনি, তাকে কি আবিষ্কার করতে পারবেন ওই তিরিশ বছরের বিবাহিত পুরুষটির মধ্যে?
নমিতা, সুমিতা এবং প্রিয়মাধবের মধ্যেকার এই উপন্যাস অতএব খতম।
আমি খতম করার কে?
আমি নিমিত্ত মাত্র।
.
সকালবেলা
অরুণমাধব শুকনো মুখে এসে প্রশ্ন করল, মিস ঘোষ, কিছু যদি মনে না করেন তো একটা কথা বলছিলাম–
বলুন।
আচ্ছা, বাবার ঘরের ওই আলমারিটা সেদিন যখন খুলেছিলাম, দেখেছিলেন আপনি?
খুলেছিলেন তো। আমার সামনেই তো খুললেন।
আচ্ছা, একটা জিনিস ছিল দেখেছিলেন?
মিস ঘোষ নিজ পদমর্যাদায় ফিরলেন।
মিস ঘোষ বললেন, এই প্রশ্নটা কি বেশ শোভন মনে হচ্ছে আপনার অরুণবাবু?
অরুণমাধব অপ্রতিভ হল।
অরুণমাধব কুণ্ঠিত গলায় বলল, আমি অন্য কিছু মনে করে বলিনি মিস ঘোষ, মানে দেখেছিলেন কিনা?
দেখেছিলাম। আলমারিটা খুলেছিলেন, দেখেছিলাম।
একটা মোটামতো খাতা ছিল দেখেছিলেন।
খাতা! তবু ভাল।
নীহার হেসে উঠল, আমি ভাবলাম টাকাকড়ি গয়নাপত্তর। কীসের খাতা? ব্যাঙ্কের পাশবই নয় তো?
না না, মনে হল যেন একটা অর্ডিনারি খাতা
সাংসারিক আয়-ব্যয়ের?
কীসের তাই তো জানি না ছাই! অথচ বেশ মনে রয়েছে, দেখেছি।
নীহার এবার তীক্ষ্ণ হবে, আপনার কি ধারণা, আপনার বাবার কোনও একখানি অমূল্য খাতা আপনার বাবার নার্স সরিয়ে ফেলেছে?
ছি ছি, এ আপনি কী বলছেন মিস ঘোষ?
কিন্তু আপনি তো তা ছাড়া আর কিছু বলছেন না। খাতাটা ছিল, খাতাটা নেই। আলমারি খোলার সময় আমি ছিলাম, আর কেউ ছিল না। অতএব
আমার অন্যায় হয়ে গেছে মিস ঘোষ, আমায় মাপকরবেন। আপনাকে পরিবারের আত্মীয়ের মতো মনে করি বলেই বলছি, বাবার মৃত্যুকালের প্রলাপের সঙ্গে ওই খাতার কোনও যোগ আছে মনে হচ্ছিল আমার।
আপনার ভুলটা কোথায় জানেন অরুণবাবু? রোগীর প্রলাপকে গুরুত্ব দেওয়া। ব্রেন যখন অকেজো হয়ে যায়, কত অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বেরোয় তা থেকে, ধারণা নেই আপনার, তাই অত ভাবছেন। আজীবন ব্রহ্মচারী সাধু-মহাত্মার প্রলাপোক্তি শুনে অনেক সময় কানে আঙুল দিতে হয়, চিরদিনের শান্ত সভ্য নম্র ব্যক্তির প্রলাপোক্তি অনেক সময় ভাবিয়ে অবাক করে দেয়, এ সব গালমন্দ ভদ্রলোক শিখলেন কখন? প্রলাপ নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
কিন্তু খাতাটা–
আমার সুটকেস খুলে দেখুন!
নীহার জানে, খুলবে না সুটকেস।
তাই নীহার স্বচ্ছন্দে বলে, খুলুন সুটকেস!
হয়তো অরুণমাধব আর তার স্ত্রী, ওই মুহূর্তের দেখা খাতাখানা নিয়ে নীহারকেই সন্দেহ করবে। হয়তো চিরদিনই নিজেরা বলাবলি করবে, আর কারও নয়, ওই মিস ঘোষেরই কাজ। ভূতে তো উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে না? তবু ভদ্রতা বজায় রাখবে।
সে সন্দেহ ঘাড়ে নিয়েই বিদায় নেবে নীহার।
অরুণমাধব বলেছে, আপনি আমাদের পরিবারের বন্ধুর মতো।
বন্ধুর কাজই করবে নীহার।
অকারণ লোকটার মনটা কালিমাখা হতে দেবে না।
কী এসে যাবে যদি অরুণমাধবের জীবনে সুমিতা এবং নমিতার রহস্য অনুদঘাটিতই থাকে?
নীহার এই রহস্য কাহিনী ভুলে যাবে।
নীহার খাতাটা পুড়িয়ে ফেলে ভাববে, আমি যাঁর মাইনে খেয়েছি তাঁর আদেশ পালন করেছি।
অরুণমাধবও ভুলে যাবে।
অরুণমাধব ভাববে, প্রলাপ প্রলাপই। ভাববে খাতাখানা বোধহয় চোখের ভ্রম।
নমিতার আত্মা কি প্রেত হয়ে নীহারের ঘাড়ে চাপবে? নিজের মনে হেসে ওঠে নীহার।…
এই পৃথিবীতে কত জীবন কত ভাবে অপচয় হচ্ছে, কত ধ্বংস হচ্ছে, কত দীর্ঘনিশ্বাস ঘুরে মরছে। পৃথিবীর বাতাসে। প্রিয়মাধব নামের একটা লোককে ঘিরে দুটো মেয়ের দীর্ঘশ্বাস যদি উদ্বেল হয়েই থাকে কখনও, সে নিশ্বাস বাতাসে বিলীন হয়ে গেছে। ওদের গাড়ি এসেছে, ওরা চলে গেছে।
যারা আছে, তারা সুখে থাক, স্বস্তিতে থাক।
নীহার ওদের পরিবারের বন্ধু।
আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো…
জীর্ণ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে দিয়ে আগুন জ্বালো।
গুনগুন করে গান গাইছিল নীহার। খাতাখানা পুড়ছিল।
এই কাগজ পোড়া গন্ধ আর ধোঁয়া অরুণমাধবের কাছ পর্যন্ত পৌঁছবে না, কারণ এটা নীহারের বাসা।
কিন্তু তবু ধোঁয়া থেকে কি রক্ষা পাবে অরুণমাধব?
প্রিয়মাধবের সেই শেষ কথা কি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে রাখবেনা তার বাকি জীবনটা? প্রিয়মাধব ওকে কখন ঠকালেন সে কথা ভাববে না ও বাকি জীবন?
আর ভাবতে ভাবতে মনে পড়বে না অরুণমাধবের, তার মা আর বাবার দাম্পত্য জীবনের অস্বাভাবিকতা?
উত্তরা তার শ্বশুর শাশুড়ির এই বুড়ো বয়েসের প্রেমের গভীরতা দেখে ঠোঁট উলটেছে, কিন্তু সত্যিই কি ছিল সেই গভীরতা?
এখন ভাববে অরুণমাধব।
তার ছেলেবেলার স্মৃতি থেকে প্রত্যেকটি দিনের কথা আর ঘটনা মনে আনবে।
ভাবতে ভাবতে অবাক হয়ে যাবে, আর মনে করবে, কী আশ্চর্য, আমার কেন সন্দেহ হয়নি?
ভাববে, অথচ সন্দেহ করবার তো ছিল।
বরাবর তো মাকে আমি আলাদা ঘরে শুতে দেখেছি। যখন অসুখে পড়লেন বাবা, তখন থেকেই শুধু–দিন দুই পরে প্রিয়মাধবের যখন জ্ঞান হয়েছিল, প্রিয়মাধব যে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, এ ঘরে কার বিছানা? কে শোবে এখানে? সে কথাও মনে পড়বে অরুণমাধবের। মনে পড়বে অরুণমাধব যখন বলেছিল, উত্তেজিত হচ্ছ কেন বাবা? ডাক্তার উত্তেজিত হতে বারণ করেছে। রাত্রে তোমায় দেখতে হচ্ছে বলে মা এখানে