ও চেঁচিয়ে ওঠে, ঘাট হয়েছে, অন্যায় হয়েছে। রোগের জ্বালায় সময়ের জ্ঞান ভুলে গিয়ে মহারানির বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটিয়ে ফেলেছি।
.
অরুণ আমায় একা পেলে বলে, মা আর কত খাটবে তুমি? একটা নার্স রাখা হোক।
আমি হেসে বলি, কূলে এসে তরী ডোবাব? এতদিনই যখন খেটে এলাম, তখন বাকি দিন কটাও–
.
ও অন্যদিকে তাকিয়ে অপ্রতিভ গলায় বলে, ডাক্তারবাবু তো বলেন, তার কোনও ঠিক নেই। হয়তো এই রকম অবস্থাতেই আরও দশ বছর
আমি ওর দিকে স্পষ্ট চোখ তুলে তাকাই।
বলি, তেমন হলে অবিশ্যিই নার্স রাখতে হবে তোকে।
ও হয়তো আমার এ কথার মানে বুঝতে পারে না। দুঃখিত গলায় বলে, তোমাকে একেবারে শেষ করে তবে নার্স রাখা হবে, এই তবে তুমি চাও?
আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করি এ আক্ষেপ ওর সত্যি, না শুধু ভদ্রতা? এ দুঃখ মায়ের জন্যে, না শুধু একটা মানুষের জন্যে?…ভালবাসা পেলেও তো বিশ্বাস করতে পারি না আমি এটা সত্যি। মনে হয় দয়া করছে, করুণা করছে। যাতে আমার আজীবনের বিতৃষ্ণা। অথচ কত লোককে দেখেছি শুধু দয়া কাড়বার জন্যেই বানিয়ে বানিয়ে দুঃখের গাথা গাইতে। বিশেষ করে মেয়েমানুষকে। অথচ আমার ওতেই
হ্যাঁ, তাই আমি অরুণের ভালবাসার চোখকেও সন্দেহের চোখে দেখেছি। ভাবছি দয়া নয় তো? ভাবছি রক্তমাংসের যোগ যেখানে নেই সেখানে সত্যি ভালবাসা আসবে কোথা থেকে?
ও যখন ছোট ছিল, ভাবতাম আমার উপর নির্ভর করতে হয়, তাই আমার উপর আকর্ষণ! মা ছেলের ভালবাসা যাচাই করতে হলে করতে হয় ছেলের বিয়ের পর। যখন ছেলেকে আর নির্ভর করতে হয় না।
কিন্তু আমি ওকে যাচাই করব কোন দাবিতে? আমায় যাচাই করবে কে?
আমি কি সত্যি মার মতো ভালবেসেছি ওকে? আমি তো ওকে আমার বলে ভাবতে পারিনি কোনওদিন। পরের জিনিস কেড়ে নিয়ে কাছে রেখেছি, সেই পাপে চিরদিন তার ভার বইছি, এই তো৷
.
দিদি, তুই স্বর্গে নরকে যেখানেই থাকিস, আমার এই দুঃসহ বঞ্চনার জীবনের যন্ত্রণা দেখতে পাচ্ছিস কি না?..যদি পাস তো একফোঁটা দয়া আমার জন্যে রাখিস।
হ্যাঁ দয়া।
যে দয়ায় আমার আজীবনের বিতৃষ্ণা।
শুধু তোর কাছে সেই জিনিসটা চাই দিদি।
আর যদি তুই এই পৃথিবীতেই থাকিস, আর আমার এই জবানবন্দির খাতা তোর চোখে পড়ে তো চোখের জল একফোঁটা ফেলিস আমার জন্যে।
অরুণকে আমি বলেছি, আমাকে শেষ করা তো তোদের হাতে নয় বাপু!
অরুণ ম্লান গলায় বলে, নয় কী করে বলি? বাবা তো সে ভার নিয়েইছেন দেখছি।
আমি হেসে উঠে বলি, যাক এতদিনে তোর বাবাকে চিনলি তুই। আহা মানুষটার কি আর মাথার ঠিক আছে?
অরুণ কিছু বলে না, হঠাৎ কোথা থেকে যেন ওর বউ এসে পড়ে নরম গলায় বলে, মাথার তো কোনও বেঠিক দেখি না। মাথা ঠিকই আছে। আপনার উপরই কেমন যেন একটা আক্রোশ–
আমি কি চেঁচিয়ে উঠব?
আমি কি ধমকে উঠব?…
না দেয়ালে মাথা ঠুকব আমি?
না কি আমার সেই চিরদিনের যত্নে লালিত বস্তুটিকে ভোগ করব এবার?
প্রিয়মাধবের ছেলে কৃতী হয়েছে, সে তার বাপের জন্যে নার্স রাখতে পারবে।
.
আশ্চর্য! এত পরিশ্রম এত অনিয়ম, তবু তো একদিনের জন্যে একটু অসুখ করছে না?
আমার মা-বাপের কোনও ফটো নেই, ফটো নেই পিসির। থাকলে এ বাড়িরই কোনও ধূলিধূসরিত দেয়ালে রং জ্বলে ঝাপসা হয়ে ঝুলত।
কারণ সিকদার বাগানের এই জরাজীর্ণ খাঁচাটা থেকে তো মুক্তি হয়নি আমাদের বাড়ি করব বাড়ি করব করতে করতেই তো প্রিয়মাধব পড়ে গেল।
ছবি নেই, তবু দেয়ালের ইটগুলো তো আছে। তাদের মধ্যে কি লুকোনো থাকে না আত্মা?
আছে ভেবেই বলি, তোমাদের এই যমজের আধখানা মেয়েটাকে কি লোহা দিয়ে গড়েছিলে?…তাই এত দুর্গতিতেও মরে না, অসুখ করে না।
কিন্তু একবার একটু অসুখ না করলে ওদের চোখে ধুলো দেব কী করে আমি? যাবার সময় কি হেয় হয়ে যাব আমি? হার মেনে চলে যাচ্ছি বলে দলিল রেখে যাব?
না না, কিছুতেই না।
আমি মানুষের মতন অসুখ করে মরে গেলাম, এ প্রমাণ রাখতে হবে।
দিদির চেয়ে বোকা হব নাকি আমি?
দিদি চালাকি করে আমার থান কাপড় চুরি করে নিয়ে পালিয়েছিল, নিজের সমস্ত বোকামি আর দুর্বলতা ওই থানখানার আড়ালে লুকোতে চেয়েছিল।
আমিই বা কেন সারাজীবনের জীবনান্তকর ফসল নিজের হাতে আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে যাব?…
সামান্য একটু অসুখও আমার কাছে এত দুর্লভ?
আশ্চর্য!
আশ্চর্য!
আমি মরে যাচ্ছি। আমি চলে যাচ্ছি।
প্রিয়মাধবকে শেষ পর্যন্ত সেবা করা আর হল না আমার। চাবিটা ওকে দিয়ে যাব। খাতাটা ও পোড়াতে বলে, পোড়াতে পারব না। ওই খাতার মধ্যে নমিতা নামের সেই মেয়েটা আছে বেঁচে।
হেমন্ত উকিলের ভাইয়েরা তো তিরিশ বছর আগে তার শ্রাদ্ধ করে সেরে রেখেছে। আর নিশ্চয় লোকের কাছে বলে বেড়িয়েছে, ঢের বারণ করেছিলাম, জোর করে চলে গেলেন। বোন-ভগ্নিপতির নতুন শখের জীবন, ওঁকে কে বা দেখেছে, কে বা যত্ন করেছে? এখন মরলেন তো? কিনা একটা বিষপোকার কামড়ে। অপঘাত আর কাকে বলে!
তবে?
নমিতা মুছে যাবে?
নমিতা রইল এই খাতার পাতায়।
.
খাতাটা মুড়ে রাখল নীহার।
দেখল, রাত তিনটে!
সময়ের জ্ঞান হারিয়ে এতক্ষণ ধরে এই কাঁচা হাতের উপন্যাসখানা পড়ছিল সে?
অরুণমাধবের মায়ের নাম সুমিতা, সে কথা শুনেছিল সে। ওঁর একজন যমজ বোন ছিল, যার নাম নমিতা, তাও শুনেছিল। কিন্তু কে ভেবেছিল তাঁরা অদ্ভুত এক উপন্যাসের নায়িকা।