আর স্ত্রীকে নিয়ে মাতামাতিটা তো প্রায় দৃষ্টিকটু।
সারাদিন তার হাঁক পাড়াপাড়ি, বউমা, তোমার শাশুড়ি কোথায় গেল? বউমা তোমার শাশুড়ি ঠাকরুন করছেন কী?…সুমিতা, তুমি যে বলেছিলে তোমার চশমাটার পাওয়ার বদলানো দরকার, কই যাবে তো চলো।… সুমিতা, কই নতুন বউকে নিয়ে আমোদ-আহ্লাদ করছ না? বলো তো থিয়েটারের টিকিট কেটে আসি।…
ওর প্রকৃতির এই প্রাচুর্য তো সবটাই কৃত্রিম নয়। এটাই ওর প্রকৃতি। ওর বিধাতার দান। এই প্রাচুর্যের ফাঁদেই আটকা পড়েছিল একদিন নমিতা নামের একটা মেয়ে। শুধু এই অগাধ প্রাচুর্যের মুখে প্রকাণ্ড এক পাথর পড়ে গিয়ে সহজ প্রবাহের পথটা গিয়েছিল চেপে। তাই সে কখনও বিকৃতির পথে, কখনও ঘূর্ণি পথে, আর কখনও পথ হারিয়ে পাক খেয়ে মরেছে।
এখন
পরের মেয়ের কাছে মান সম্মান বজায় রাখবার জন্যে সেই পাথরটাকে জোর করে সরাচ্ছে ও, তাই কখনও বা কৃত্রিম লাগছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারি এই অভিনয়টাই ওর আসল। এই জীবনটা পেলেই ও বর্তে যেত।
কিন্তু ওর বিধাতা কিছুতেই যে বর্তাতে দেবেন না ওকে। এই পণ করে রেখেছেন। কী দোষ আমার, কী বা দোষ ওর ছেলের বউয়ের?
শুধু উত্তরার হিংসের চোখ অতবড় দেহটাকে ভেঙে-চুরে হুড়মুড়িয়ে ফেলে দিল, এ কথা বলব। কোন মুখে?
ওর জীবনের অমিতাচারের ইতিহাস তো আমার অজানা নয়!
তবু ভাবি উত্তরা যদি অতটুকু বয়েসের খোলসে অতখানি পাকা মনটা ভরে নিয়ে না আসত!
হয়তো চারখানা থিয়েটারের টিকিট কেটে আনত প্রিয়মাধব, হাঁক পাড়ত খোকা নাম! বউমা তোমার শাশুড়ি ঠাকরুনকে নামাও মা!
খোকাও নামত না, বউমাও নামত না।
নামতাম আমি।
চাপা গলায় বলতাম, ওরা যাবে না। চলো আমরাই যাই।
প্রিয়মাধব আমার চাপা গলার মর্যাদা রাখত না। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলত, কেন, ওঁরা যাবেন না কেন শুনি? কী রাজকার্য পড়ল ওঁদের?
আমি ওকে নিবৃত্ত করতে পারতাম না।
তখন অরুণমাধব নেমে আসত, ভারী মুখে বলত, ওর মাথা ধরেছে নাকি, চলো আমরাই যাই।
প্রিয়মাধব বলত, ঠিক আছে। তাই যাব! আশ্চর্য, মাথাটাও খুব হাতধরা আমার বউমার। দরকার মাফিক ঠিক সময়ে ধরে ওঠে।
আমি হাঁ হাঁ করে বলতাম, কী যে বলো! মাথাধরার একটা ধাত থাকে বুঝলে? খোকা, তুই যাবি মানে? বউমা একা থাকবে?
খোকা চাপা ভারী গলায় বলত, থাকলেই বা, ভূতে তো আর খেয়ে ফেলবে না। চলো চলো। বুঝতে পারতাম না, এই বিরক্তিটা কার উপর! আমাদের নির্লজ্জতা, না বউমার অবাধ্যতা, কোনটা ওকে এমন প্রকৃতিছাড়া অসহিষ্ণু করে তুলছে।
তবু নির্লজ্জ আমাদের হতেই হচ্ছে।
ভালবাসার আধিক্য দেখানো ছাড়া উপায় কোথায় আমাদের? পায়ের নীচে মাটি কই?
ভালবাসা না দেখালে কীসের.জোরে খাড়া হয়ে থাকব ওদের সামনে? প্রিয়মাধবের সিদ্ধান্ত ভুল নয়।
.
আমার সঙ্গে ওর সতীনের সম্পর্ক নয়, এটা যেন মাঝে মাঝে ভুলে যায় উত্তরা। ওর চোখে সেই দৃষ্টি। অথচ বউকে নিয়েও তো কম মাতামাতি করতে চেষ্টা করেনি প্রিয়মাধব। বউমা, কী শাড়ি তোমার পছন্দ? বউমা, কোন মাছ খাবে বলো? বউমা, কোন ফুলে তোমার রুচি? বউমা, মুখখানি কেন পেঁচা করে বসে আছ মা! মায়ের জন্যে মন কেমন করছে বুঝি? বলো তো পৌঁছে দিয়ে আসি
এ তো হরদম চালিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে।
কিন্তু চালাতে পারেনি।
পাথরে ঠেক খেয়ে ফিরে এসেছে।
মাঝে মাঝে বলেছে প্রিয়মাধব, আচ্ছা, ও কি আমাদের সন্দেহ করে?
আমি উড়িয়ে দিয়েছি। বলেছি, পাগল? সন্দেহের কারণ কী?
তবে অমন করে কেন ও?
কত মেয়ের কত রকম প্রকৃতি!
আমি বলতাম, কারও জীবনকে মহানিশা করার ক্ষমতা কি মানুষের? যার যা বিধিলিপি।
ও মাথা হেঁট করত।
বলত, তা বটে!
এমনি চলতে চলতে আমরা কি ক্রমশ পরস্পরের কাছাকাছি এসে যাচ্ছিলাম?
জানি না।
এর মধ্যেই তো এল সেই ভয়ংকর দিন!
প্রিয়মাধবের স্ট্রোক হল।
চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেল ও।
যেন ছুটন্ত ঘোড়া দুর্বার বেগে ছুটতে ছুটতে খাদে গড়িয়ে পড়ে গেল।
সেই ভয়ংকর মুহূর্তে আমি নাকি ওর নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম!
জানি না, আমার জ্ঞান ছিল না।
পরে উত্তরা মুচকি হেসে বলেছিল, আপনারা বুঝি দুজনেই দুজনকে নাম ধরে ডাকেন মা?
ওর সামনে বেশিক্ষণ ভুরু সোজা রাখতে পারি না আমি, সেদিনও পারিনি। বলেছিলাম, তার মানে?
ও নিরীহ মুখ নিয়ে বলেছিল, মানে কিছু না। যেদিন বাবা সিঁড়িতে গড়িয়ে পড়ে গেলেন, সেদিন দেখলাম কিনা আপনি বাবার নাম করে চেঁচিয়ে ডেকে উঠে ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়লেন।
আমি এই ধৃষ্টতার দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, বিয়ে দেবার আগে মেয়েকে সহবত শিক্ষা দিতে হয়, এটা বোধহয় তোমার মা জানেন না বউমা!
ও মুখ কালো করে উঠে গিয়েছিল।
এই মুখ কালো করে উঠে যাওয়ার ভঙ্গিটাই ওর সব সময়ের ভঙ্গি!
ভাবি, বলব না কিছু।
তবু বলা হয়ে যায়। হয়তো ও বলিয়ে ছাড়বে পণ করেই আসে।
আমি যদি দৈবাৎ কোনও দিন সময় পেয়ে অরুণের কোনও প্রিয় খাদ্য তৈরি করে রাখি, উত্তরা। আত্মস্থ গলায় বলে, কেন বৃথা কষ্ট করছেন, ওসব ও খেতেই পারে না।
আমি যদি বামুন ঠাকুরের কাছে গাওয়া ঘিয়ের বোতল রেখে বলে রাখি দাদাবাবুর খাবার সময় মনে করে দিও ঠাকুর! উত্তরা আমার কানে পৌঁছনো সুরে আদেশ দেয়, দাদাবাবুকে কাঁচা ঘি দিও না ঠাকুর, সহ্য হয় না ওর!
আমি যদি দৈবাৎ কোনও দিন বলি, তোমার শ্বশুর ডাকাডাকি করছেন বউমা, চললাম, তুমি তোমার শ্বশুরের এই হালুয়াটুকু করে আনো তো৷