বললাম, সেটাই তো আসল। নামই তো সব! নাম জপই তো সব। নাম জপেই দেবতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা।
হল শুরু কবিত্ব! তোমার কি বিশ্বাস বুড়ো সেই পুরনো কালের দুর্বলতা মনে করে বসে আছে?
হেসে বললাম, মনে করে কি আর বসে থাকতে হয়? যে থাকবার সে নিজেই মনের মধ্যে চেপে বসে থাকে। আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি, এ যদি আমি না হয়ে সত্যিকার সুমিতা হত, ও ঠিক অনুভব করতে পারত!
প্রিয়মাধব বিশ্বাস করেনি।
প্রিয়মাধব হেসেছিল।
তারপর প্রিয়মাধব গাড়িতে আসতে আসতে একটা কথা বলেছিল।
হ্যাঁ, গাড়িতে শুধু ও আর আমিই আসছিলাম। ও বলল, সুমিতা
হেসে বললাম, দেখ হাতে হাতে প্রমাণ। নামের মহিমা! বুঝতে পারছ নামই জপের বস্তু।
ও আস্তে বলল, সে তো বুঝি! কিন্তু একটা কথা–এতদিন সংসারে কোনও চোখ ছিল না, আমাদের মধ্যেকার ফাঁকি ধরা পড়ত না, এখন বাড়িতে বউ আসবে, যত ছেলেমানুষই হোক, তবু মেয়ের চোখ, যে যদি ধরে ফেলে?
ওর কথার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছিলাম না। বলেছিলাম, মেয়ের চোখ যে ভয়ংকর বস্তু আমিও সে সত্য অস্বীকার করি না। তা হলে কী করা? চলে যাব? তা বলো তো কোনও তীর্থে-টির্থে চলে যাই
আঃ নমিতা!
ও রেগে উঠল।
রাগের গলায় বলল, আঃ নমিতা, আমি বলতে চাইছি, বাইরেটা আমাদের খুব মজবুত রাখতে হবে বুঝলে? দেখাতে হবে আমাদের মধ্যে কোনও ফাঁক নেই, কোনও ফাঁকি নেই। আমরা খুব সুখী!
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, তার মানে ভেজালের উপর আরও ভেজাল? কিন্তু তাতে লাভ?
লাভ?
প্রিয়মাধব গাঢ় গলায় বলল, লাভ হচ্ছে প্রেস্টিজ বজায়। শ্বশুর শাশুড়ির মধ্যে যদি ইয়ে না দেখতে পায়, পরের মেয়ে জো পেয়ে যাবে, মানবে না, অবজ্ঞা করবে!
বিস্মিত হয়েছিলাম।
ও এমন ভাবে তলিয়ে ভাবতে পারে, কখনও টের পাইনি। আস্তে বললাম, তা হলে কী করতে হবে বলো?
ওই তো। বলছি যে নতুন চোখকে দেখাতে হবে আমরা খুব সুখী–
বুঝেছি! হেসে উঠলাম আমি, বোঝাতে হবে আমরা খুব সুখী, আমাদের মধ্যে প্রেমের বন্যা বইছে, আমরা দুজনে একদণ্ড না দেখলে অধীর হয়ে উঠি
প্রিয়মাধব বলল, জানতাম তুমি বুঝতে পারবে! শুধু সমস্ত জীবনটাই তুমি ব্যঙ্গের ছলনায় নিজেকে ঢেকে রেখে এলে!
তা একটা কিছু দিয়ে তো ঢাকতেই হবে–গম্ভীর গলায় বললাম, মানুষ তো পশু পক্ষী নয় যে কাপড়-চোপড় না হলেও চলবে তার!
ও বলল, সেই তো। চলে না বলেই তো এ কথা বলা! মোটা পোশাকে নিজেদের ঢাকতে হবে। পরের মেয়ের সামনে নিরাবরণ হলে চলবে না।
দেখা যাক! চেষ্টা করব সুখীর ভূমিকা অভিনয় করতে।
ও একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল।
বলল, অথচ এমন দিনও ছিল, যখন অভিনয় না করেও চলত! সত্যিই সুখী ছিলাম আমরা।
আমি লীলাভরে বলে উঠলাম, তাই নাকি? সেটা কবে গো? খ্যাপার মতো কবে সেই পরশ পাথর পেয়ে হারিয়েছি?
ও বলল, তুমি ঠাট্টা করছ। কিন্তু সেই প্রথম প্রথম, সুমিতাকে হারিয়েও! তখন কি সুখী ছিলাম না আমরা?
.
হয়তো ওর কথা ভুল নয়।
হয়তো তবুও আমরা সুখী ছিলাম।
আমাদের সেই যন্ত্রণাময় যৌবনের রাত্রির মার খেয়ে খেয়েও সুখীই ছিলাম।
কারণ আমাদের মধ্যে আকর্ষণের তীব্রতা ছিল তখন! পরস্পরকে আঘাত হানার মধ্যেও তাই উগ্র একটা সুখের স্বাদ ছিল।
আর অরুণ বড় হয়ে ওঠার পর সম্পর্কটাও কেমন সহজের সুরে গেঁথে গিয়েছিল।
অরুণের কাছে ফাঁকি ধরা পড়ার ভয়েই হয়তো সেই সুখের অভিনয়ের মধ্যে সহজের স্বাদ পাওয়া।
প্রিয়মাধব বলত, অরুণ। তোর মাকে বল তো গোটা তিরিশ টাকা বার করে রাখতে।…খোকা, তোর মার সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক কর সামনের ছুটিতে কোথায় আমরা বেড়াতে যাব।…বলল তো, সুমিতা তুমি আর তোমার ছেলেতে মিলে দেখছি এক দল হয়ে আমায় কোণঠাসা করে জব্দ করে ফেলছ। সুমিতা, এবার বোর্ডিঙে যাবার আগে তোমার ছেলের কী কী লাগবে লিস্ট করে রেখো!
.
খোকা, তোর মা!
সুমিতা, তোমার ছেলে!
বারবার এই মন্ত্র জপ করতে করতে সিদ্ধ হয়ে উঠছিল যেন ও।
আমিও সেই সিদ্ধির সুরে সুর লাগাতাম বইকী! বলতাম, দেখ থোকা, তোর বাবার প্রত্যাশায় বসে থাকলে আমাদের আর বেড়াতে যাওয়া হয়েছে!… দেখিস খোকা লিস্ট দেখে তোর বাবা প্রথমে তর্ক করবে, বাড়াবাড়ি বলবে, তারপর নিজেই ডবল জিনিস কিনে আনবে।
এমনি আরও কত কথার চাষই করতাম আমরা খোকাকে ঘিরে ঘিরে।
মায়ের মতো শান্ত মিতভাষী অরুণ আমাদের এই লীলার দর্শক হয়ে শুধু লাজুক মুখে হাসত।
বোর্ডিং থৈকে যখন আসত অরুণ, আমরা ঠিক মা বাপের মতোই শহরের স্টেশনে যেতাম ওকে আনতে। ছুটিতে বাড়ি আসার সেই প্রথম আবেগে অরুণ হয়তো একটু বেশি কথা কয়ে ফেলত, আমি বলতাম, খোকা তুই বাবার সঙ্গে বেশি কথা বলছিস।
অরুণ লজ্জা পেয়ে তার গল্পের শ্রোতা হিসেবে আমাকেই লক্ষ্য করত। প্রিয়মাধব তখন বলত, খোকা ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে না, ওদিকটা বড় ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে!
হেসে উঠতাম তিনজনেই।
তখন তো আমরা খুব অসুখে ছিলাম না।
পাছে লোকে আমাদের ভিতরের সম্পর্কের গলদ বুঝতে পারে, সেই ভেবে লোকের সামনে পরম সুখী দম্পতি সেজে সেই অভিনয়, তারপর প্রিয়মাধবের সেই বিষণ্ণ কাতর আক্ষেপ, এটা যদি সত্যিই হত নমিতা! যদি কোনও মন্ত্রবলে আমরা ভুলে যেতে পারতাম তুমি সুমিতা নও!
আর তারপর আমার কৌতুক হাস্যচ্ছটা, ব্যঙ্গ উপহাস, পরিহাস! ওর বিষণ্ণতা কেটে যেত। হয়তো রাগত, হয়তো হাসত।