হয়তো বা বলত, কারণটা বুঝছ না? পাছে বরের দৃষ্টিপাত পড়ে যায়। অবশ্য তা নিয়েও হাসাহাসি করত।
বলত, দৃষ্টিতে তো নতুন কিছু পড়বে না? একই মূর্তি, আলাদা আকর্ষণ আসবার কারণ নেই।
বলত। বেরিয়ে গেলেই বলত।
অবশ্য কালেকস্মিনেই আসত তারা। সুমিতা কারও বাড়ি গেলে একাই যেত প্রিয়মাধবের সঙ্গে। নমিতা যেতে চাইত না। বলত, আমার এখন কাজ আছে।সুমিতা বেশি পীড়াপীড়ি করলে বলত, তুই তো আচ্ছা বোকা দিদি, দুজনে গেলে লোকে কী বলবে, ভুলে যাচ্ছিস?
কী আবার বলবে? নমিতা একটু বাঁকা হাসি হেসে বলত, ডাইনেবাঁয়ে চিনির নৈবিদ্যি!
যেত না নমিতা, বাড়িতে কাজ নিয়ে থাকত। আর তারপর তো কাজ বেড়েই গেল। ক্রমশই বাড়তে লাগল।
অরুণমাধব জন্মাল।
সেই এক আনন্দের দিন গেছে সুমিতার। চা-বাগানের ওই কোয়ার্টার্সের বাইরে যে আর কোনও জগৎ আছে, ভুলেই গেল যেন। দুই মা মিলে একটা শিশুকে নিয়ে রাজ্য রচনা করল একটা।
অপুট সুমিতা ছেলেকে আদর করা ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। সুপটু নমিতা তার সব কিছু কাজ করে, শিশুর তো অতএব আঠারো আনা।
কিন্তু নমিতা?
নমিতাও কি সুখের সাগরে ভাসত? দিদির ছেলে থেকেই তার সব সম্পূর্ণতা, এই কি ভাবত সে?
নমিতার কথা বিশেষ জানার উপায় নেই।
নমিতা তো অরুণের জন্মের কিছু দিন পরেই মারা গেল। মাস আষ্টেকের ছেলে তখন অরুণ, দেশে আসবে সুমিতা ছেলের মুখে ভাত দিতে, হঠাৎ তছনছ হয়ে গেল সব। সুমিতার জীবনের সুর গেল কেটে।
সেই একই সময়ে প্রিয়মাধবের কোম্পানি আরেক বুনো জায়গায় বদলি করে দিল বড় একটা বাগান কিনে, আর অকস্মাৎ নমিতা মারা গেল একটা পোকার কামড়ের জ্বরে।
ওই বিষাক্ত পোকা থাকে বাগানের আশেপাশে। অসতর্ক কুলিকামিনদের ছেলেমেয়েরা প্রাণ হারায় মাঝে মাঝে, কিন্তু তাই বলে সুমিতার বোন প্রাণ হারাল? সুমিতা এত অসতর্ক হল?
হল।
সুমিতার ভাগ্য সুমিতাকে নিঃস্ব করল। সুমিতার শৈশব কৈশোর বাল্যের একমাত্র সাথী, সুমিতার যৌবনসুখের একমাত্র দর্শক, সুমিতার সংসার-জীবনের একমাত্র অবলম্বন ঝরে পড়ল মুহূর্তের মধ্যে।
দেশে এসে ছেলের ভাত দেওয়া আর হল না সুমিতার, চলে গেল সেই বুনো বাগানে। দীর্ঘকাল পড়ে থেকেছে সেখানে, ছেলেকে বোর্ডিং-এ রেখে মানুষ করেছে, তারপর প্রিয়মাধব যখন আরও কিছুদিন এ বাগান সে বাগান করে অবশেষে অবসর নিয়ে দেশে ফিরেছেন, সুমিতা কলকাতায় এসে গুছিয়ে বসেছেন, ছেলের বিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু সেই বিয়ের পরই আবার ঝপ করে ভেঙে পড়ল তাসের প্রাসাদ।
প্রিয়মাধব অসুখে পড়লেন।
নমিতার মৃত্যুর মতোই আচমকা এল এই মৃত্যু।
তা, মৃত্যু ছাড়া আর কী?
জীবন থেকে তো নির্বাসন ঘটল প্রিয়মাধবের। যে-জীবনকে আঁকড়ে থেকেছেন প্রিয়মাধব চিরটা দিন।
চিরদিনই বিষাদকে ভয় প্রিয়মাধবের, শোককে বরদাস্ত করতে পারেন না। নমিতার মৃত্যুর পর তাই প্রিয়মাধব ইচ্ছে করে হইচই করেছেন। ইচ্ছে করে স্ফুর্তি করেছেন, সুমিতাকে কিছুতেই বিষাদে ডুবে থাকতে দেননি। বলেছেন, মৃত্যুর সাধনা করে লাভ কী? জীবনের সাধনা করো।
.
সেই প্রিয়মাধব জীবনকে হারালেন। চিরতরে হারালেন।
সুমিতা যদি নমিতার শাশুড়ির মতো হতেন, নিশ্চয় বউকে অপয়া বলতেন।
কিন্তু তেমন নন সুমিতা।
তাই ভাগ্যের এই দুঃসহ নিষ্ঠুরতা মেনে নিয়েছেন। আর কাউকে দায়ী করেননি। জীবনপাত করে সেবা করেছেন স্বামীর। তারপর একদিন আস্তে বিদায় নিয়েছেন।
তদবধি নার্স।
নার্স ছাড়া আর কে করবে?
অরুণমাধবের সাধ্য কী?
প্রিয়মাধবের খুঁতখুঁতুনির বোঝা পাহাড়ের বোঝাঁ।
নার্স এল।
কতজন এল গেল।
কাউকে বরদাস্ত করতে পারেন না প্রিয়মাধব। প্রতিটি বিষয়ে খুঁত কাটেন, ব্যঙ্গ করেন বিদ্রূপ করেন, আর অরুণমাধব যখন বাবাকে দেখতে এ ঘরে আসে, বলেন, পয়সা কি তোমার এত বেশি হয়েছে অরুণ যে, এই চিড়িয়াখানার মালটিকে মোটা পয়সা দিয়ে পুষছ। ফেলে দেওয়ার মতো পয়সা থাকে, অনাথ-আশ্রমে দান করো না।
অরুণ লজ্জায় অধোবদন হত, লাল হয়ে বলত, কী বলছেন বাবা?
প্রিয়মাধব বলতেন, ঠিকই বলছি। এর থেকে একটা বনমানুষ এনে বাপের সেবায় লাগিয়ে দিও, কাজ যেমন চলছে চলে যাবে।
বনমানুষ!
এর পর আর কোন মানুষটি থাকবে? পাগলের সেবা করবে বলে তো আসেনি তারা?
অনেক জনকে বিদায় করে এখন নীহার। নীহার একটু বেশি বুদ্ধিমতী আর বেশি সহিষ্ণু বলে অনেকদিন টিকে আছে। প্রিয়মাধবের কোনও কথাই গায়ে মাখে না সে। এ ঘরে এসে উত্তরাকে বলে, উঁহু, ভয় পাবেন না, আমি নড়ছি না। আপনার শ্বশুরের শ্রাদ্ধের ভোজ খেয়ে তবে যাব।
আশ্বাস!
এই আশ্বাসের জোরে অরুণ আর উত্তরা ক্রমশই বাবার জন্যে উৎকণ্ঠিত হওয়া কমিয়ে দিয়েছে। জানে, মিস ঘোষ আছেন।
নীহারের বয়েস কম, কিন্তু দৃঢ়তা আছে।
যখন অরুণমাধব রাত্রে একটু সাড়াশব্দ উঠলেই ভয় পেত, মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পেলে ফ্যাকাসে হয়ে যেত, তখন নীহারই বলত, যান তো, শুতে যান তো! মাথা খারাপ করতে হবে না। আপনারাই যদি জেগে বসে থাকবেন, আমি তবে আছি কী করতে?
কোনও সময় বা বলত, এত ভয়ই বা কীসের? মা বাপ কি মানুষের চিরদিনের? এই তো মা গেছেন, বেঁচে নেই আপনি?
শুনে উত্তরা নার্সের ওপর কৃতজ্ঞ হত। যে কথাগুলো নিজে সে বরকে বলতে পারে না, সেটা অপর কেউ বলে দিচ্ছে–এতে অবাক বিস্ময়ে মুগ্ধ হত।