এ লেখা চেনে নমিতা।
যদিও বছরে একটি কি দুটি চিঠি আসে এই হাতের লেখায়। আসে বিজয়া দশমীতে, আর হয়তো বা এমনি কুশল সংবাদ চেয়ে, নয়তো প্রিয়মাধবের জন্মদিনে, আশীর্বাদ দিয়ে।
যা দেখে প্রিয়মাধব হেসে বলত, তিথিটা তো ভুলেও যায় না বুড়ি।
দেখত, বলত, তুলে রাখত ড্রয়ারে।
কিন্তু সে চিঠি কদাচ কি খামে?
না, এযাবৎকখনও সে দৃশ্য দেখেনি নমিতা। নিশ্চিত একখানি পোস্টকার্ড। প্রায় একই ভাষা, একই ভঙ্গি, একই বক্তব্য। পর পর পাঁচখানা চিঠি সাজিয়ে রাখলে দেখা যাবে তফাত মাত্র নেই।
সহসা খামে কী লিখেছেন উনি?
আর এই ঠিকানা?
কাকে দিয়ে লিখিয়েছেন?
খামের উপরকার সেই পরিপূর্ণ অক্ষরগুলো যেন গ্রাস করে ফেলছিল নমিতাকে। তবু আস্তে ওই আঁকাবাঁকা লেখাটা চোখের সামনে তুলে ধরল। নতুন কী আছে এতে? হ্যাঁ, এবারে বক্তব্য নতুন।
প্রিয়মাধবের বাবা মৃত্যুশয্যায়, প্রিয়মাধব যেন পত্রপাঠ মাত্র বউমাকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসে। খুব শীঘ্র ব্যবস্থা না করলে হয়তো বাপের সঙ্গে শেষ দেখা হবে না প্রিয়মাধবের। দিন যে কীভাবে যাচ্ছে তিনিই জানেন আর বৃন্দাবনচন্দ্রই জানেন। অবশেষে লিখেছেন, তবে বৃন্দাবনচন্দ্রের কৃপায় একটি সংসার বৈরাগিণী বিধবা মেয়ে উপযাচক হয়ে যে সেবা ও সাহায্য করছে, তা দুর্লভ। মেয়েটির দেখা না পেলে কী যে করতেন বৃদ্ধা! দেখে মনে হয় যেন চিরকালের চেনা, কতজন্মের আপন।
.
নমিতার ঠোঁটটা দাঁতের চাপে কেটে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি আমি, দেখতে পাচ্ছি নমিতা সেই চিঠিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ছে।…দেখতে পাচ্ছি নমিতা সেই চিঠি আর চিঠির খামের কুচিগুলোয় দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে আগুন ধরাচ্ছে।…
দেখতে পাচ্ছি সেই পোড়া ছাইগুলোকে বাথরুমে জল ঢেলে নিশ্চিহ্ন করছে নমিতা। তারপর দেখতে পাচ্ছি নমিতা বিছানায় পড়ে হাঁপাচ্ছে।
দেখতে পাচ্ছি প্রিয়মাধব এলে বলছে, অসুখ করেছে?
প্রিয়মাধবও আজ স্তিমিত।
আজ বাসায় ফিরে অরুণমাধবকে দেখবে না, এই বিষণ্ণতা নিয়ে ঢুকেছে। তবু ব্যস্ত হল। বারবার বলতে লাগল, কদিন খুব খাটনি গেল তো! ব্যস্ত হয়ে উঠল, ওষুধ ওষুধ করে।
আর হয়তো সে ব্যস্ততা নিরর্থকও হল না। অসুখ তো সত্যিই করেছিল নমিতার। ভিতরের অসহ্য যন্ত্রণায় জ্বরই এসেছিল ওর।
কী করবে ও?
কেমন করে জানাবে প্রিয়মাধবকে তার বাবার অবস্থা।
নমিতা কি বলবে, হঠাৎ অন্যমনস্কতায় খামটা ছিঁড়ে ফেলেছিলাম, পড়ে দেখলাম—
কী বলবে প্রিয়মাধব?
ঠিক আছে খুলেছ ক্ষতি নেই, কিন্তু চিঠিটা?
নমিতাকে তা হলে বলতে হবে, কোথায় রেখেছি খুঁজে পাচ্ছি না!
প্রিয়মাধবও তবে পাওয়া যাচ্ছে না ভেবে নিশ্চিন্ত হবে? খুঁজবে না?
নমিতা কি বলবে অচেনা অজানা একটা লোক হঠাৎ এসে খবর দিয়ে গেল?
প্রিয়মাধব পাগল নয় যে সেই অবাস্তব কথাটা শুনে বিশ্বাস করবে। তা ছাড়া–হ্যাঁ, তা ছাড়া বাপের ওই মৃত্যুশয্যার খবরটা দিলেই বা চলবে কেন প্রিয়মাধবকে? প্রিয়মাধব তা হলে ছুটবে না? না, প্রিয়মাধবের মার বউমাকে নিয়ে ছুটবে না অবিশ্যি, একাই ছুটবে। মা বাপের সামনে, মরণোন্মুখের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে না সুমিতা হয়ে যাওয়া নমিতাকে নিয়ে।
অতএব একাই ছুটবে। আর সেখানে গিয়ে দেখতে পাবে সেই মেয়েকে। যে নাকি ওর মার কতজন্মের আপন।
না, না, তার চেয়ে নমিতার অসুখ বাড়ুক। নমিতা বিছানা থেকে উঠতে না পারুক।
.
না, বাপের সঙ্গে শেষ দেখা হয়নি প্রিয়মাধবের। কদিন যেন পরে ধিক্কারের ভাষার একখানা পোস্টকার্ড এসেছিল।
যাতে প্রিয়মাধবের বাপের মৃত্যুসংবাদ ছিল, আর ছিল ওর মায়ের তীর্থযাত্রার সংবাদ। সংসারই যখন ত্যাগ করেছেন, তখন ছেলের হাতের আগুন পাবার প্রত্যাশাই ছিল ভুল। সে ভুল ভেঙেছে তাঁর, স্বামীর পারলৌকিক কাজ সাঙ্গ করে গুরুদেবের সঙ্গে তীর্থ পর্যটনে বেরোচ্ছেন তিনি। কোথায় যাচ্ছেন জানেন না। ভগবান যেখানে নিয়ে যান।
অক্ষর আঁকা আঁকা, কিন্তু বক্তব্য স্পষ্ট। প্রিয়মাধবের মার পুরনো চিঠির সঙ্গে এ চিঠির মিল নেই কোথাও।
প্রিয়মাধব মাথায় হাত দিয়ে পড়েছিল। বলেছিল, এ চিঠির মানে কী বলতে পারো?
নমিতা শুকনো গলায় বলেছিল, কী করে বলব?
অনেকক্ষণ উদভ্রান্তের মতো পায়চারি করেছিল প্রিয়মাধব। বলেছিল, খুব অন্যায় হয়ে গেছে আমার, খুব অন্যায় হয়ে গেছে! ওঁরা যে বুড়ো হচ্ছেন, সে খেয়াল করিনি। মাসে মাসে একটা মনিঅর্ডার, আর তাতেই দুছত্র লেখা, এতেই কর্তব্য শেষ হল ভেবেছি। ছেলে দেখাতে বলেছিলেন, দেখাইনি। আমি একটা জানোয়ার সুমিতা, আমি একটা রাসকেল!
সুমিতা!
সুমিতাই বলত বইকী! বলে বলে সহজ অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, ওরও গলায় বেসুরো বাজত না, আমারও কানে বেখাপ্পা লাগত না।
আমি শুকনো মুখে বললাম, তোমার আর দোষ কী? তুমি তো জানতে না অসুখ?
অসুখ জানতাম না, বয়েস জানতাম তো!
ওঁরা তো তোমার সাহায্যের প্রত্যাশী ছিলেন না!
খোকাকে দেখাব এ প্রত্যাশা করেছিলেন।
খোকা!
আমি ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বললাম, খোকা জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই তো?
হ্যাঁ! খোকার জন্মের পরই–।
মাথার চুলগুলো মুঠোয় চেলে ও তীব্রস্বরে বলে ওঠে, মুখ দেখাবার পথ আর ছিল কোথায়?
.
বাবার সঙ্গে শেষ দেখা হল না, বাবার সঙ্গে শেষ দেখা হল না–এই আক্ষেপটা নিয়ে বড় বেশি বাড়াবাড়ি করল প্রিয়মাধব। যদি ছুটে চলে গিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারত, হয়তো এতটা অশান্তি ভোগ করত না, কিন্তু ওর মা সে পথ বন্ধ করে দিয়ে গেছেন। ওর সেই রুদ্ধ আবেগে তাই অমন করে মাথা কুটে মরছিল।