জানি না কেন এই নিপীড়ন।
এইটাই কি ও নিজের শাস্তি বলে গ্রহণ করেছিল? না কি ওর একেবারে মর্মলোকের সেই পবিত্রতম বস্তুটিকে আমার নির্লজ্জ হিংসার দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখতে চেয়েছিল?
কিন্তু এও কি আমার পক্ষে ভয়ানক একটা অপমান নয়?
তবু আমি সেই অপমানকে উদঘাটন করে দিইনি। আমি বুঝতে দিইনি ওর সেই গোপনীয়তাটুকু টের পেয়ে গেছি আমি।
ও সব বিষয়ে আমার মুখাপেক্ষী, তাতেই যেন বিভোর আমি। ও যে প্রতি মুহূর্তে ডাক দেয় সুমিতা সুমিতা তাতে যেন নমিতার সব পাওনা পাওয়া হয়ে গেছে।
প্রিয়মাধবের ওই মুখাপেক্ষিতাটুকু কিন্তু কৃত্রিম ছিল না। ওটা নইলে ওদের মতো পুরুষ মানুষ বাঁচে না। একজনের হাতে সব ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়াই ওদের মতো লোকের প্রকৃতি। নমিতা সেই ভারবাহী পশু!
সেই পশুটাকে ও একেবারে যে ভালবাসত না তা নয়। আগে যে আকর্ষণটা ছিল, তার তীব্রতা মুছে গেলেও ওর প্রয়োজন ওকে ভালবাসিয়েছিল।
.
মিথ্যা সুমিতাকে দিয়ে ওর সম্ভ্রম বেঁচেছে, সন্তান বেঁচেছে, সংসার বেঁচেছে, তাই তার কাছে সে কৃতজ্ঞ। আর নমিতা নামের মেয়েটা চিরদিন ওই প্রিয়মাধবকে ভালবেসে এসেছে, নিজের সকল অহমিকা বিসর্জন দিয়েছে তার আকর্ষণে পড়ে, তাই তাকে একটু মমতা করেছে।
ওই নমিতা যদি সম্পূর্ণ সুমিতা হয়ে যেতে পারত, হয়তো হারানো সুমিতা হারিয়েই যেত, নমিতার জীবনটা এমন অনাসৃষ্টি হত না। দু নৌকোয় পা দেওয়া নমিতা এখন বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
তার সেই অফুরন্ত কর্মশক্তি, অগাধ জীবনীশক্তি সব ফুরিয়ে এসেছে। অরুণমাধবের বউয়ের হাতে সংসার তুলে দিয়ে নিশ্বাস ফেলতে চায় সে। কিন্তু নিশ্বাস ফেলা হয়নি নমিতার। প্রিয়মাধবের সেই শালতরুর মতো স্বাস্থ্য-সতেজ দেহহঠাৎ হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল। হয়তো এও নমিতারই অপরাধের ফল।
স্বাস্থ্যরক্ষার যে খোলা দরজাটা দেখিয়ে দিয়েছিল সে প্রিয়মাধবকে, সেই পথ দিয়েই এসেছে এই ভাঙন, এই সর্বনাশ।
এখন যদি প্রিয়মাধব সেই নমিতাকে অহরহ তীব্র আর তীক্ষ্ণ বাক্যের বাণে বিধতে থাকে, যদি তাকে অপমান করেই সুখ পায়, যদি ওকে পীড়ন করেই উল্লাস অনুভব করে,কী করে তাকে দোষ দেবেনমিতা?
কিন্তু অরুণমাধবের বউ?
সে তো অনেক পরের কথা! প্রিয়মাধবের তীব্রতা আর তিক্ততা? সেও তো অনেক পরে।
মাঝখানে কত কত দিন পার হয়ে গেল না? যখন প্রিয়মাধব শালতরুর মতো সোজা আর সতেজ ছিল। যখন ছুটি হলেই অরুণমাধব চলে আসত বোর্ডিং থেকে, আর চা-বাগানের সাহেব মেমসাহেবের অদ্ভুত সংসারে লাগত উৎসবের স্পর্শ!
ছেলে এলে আহ্লাদে যেন উথলে উঠত ম্যানেজার সাহেব। কী করলে ছেলেকে সম্যক যত্ন করা হবে যেন ভেবে পেত না। রোজ ভোজ লাগাত, রোজ বাড়িতে লোকজন ডাকত, মাইলের পর মাইল গাড়ি করে বেড়িয়ে বেড়াত ছেলেকে নিয়ে। দাস-দাসীকে অপর্যাপ্ত বকশিশ দিত, আর সেই নৈশভ্রমণটা একেবারে চাপা দিয়ে ফেলত।
যেন খোকা জেনে ফেললেই ওর সর্বনাশ ঘটে যাবে।
আমার মনে হত এও যেন সুমিতার প্রতিই সম্মান! সুমিতা পবিত্র, সুমিতার ছেলে পবিত্র, সেখানে নিজের ধুলোমাখা অপবিত্র মূর্তিটাকে দেখাতে পারবে না সে।
মনের অগোচর পাপ নেই।
ভাবতাম নমিতা যদি এমন করে ইস্পাতের বর্মে নিজেকে ঢেকে না রাখত, যদি প্রিয়মাধবের সেই আছড়ে পড়ার দিনে নিজেকে বিকিয়ে দিত, নমিতার গর্ভেও নিশ্চয় আসত সন্তান। সেই সন্তানকে কি প্রিয়মাধব এমন সম্মান করত, সমীহ করত, প্রাণ উজাড় করে ভালবাসত?
এ প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত হয়ে নিজের মনের কাছে একটা উত্তরই পেয়েছি-না না না।
নিজেকে বিকিয়ে দিলে নমিতা নামের মেয়েটা প্রিয়মাধবের বাঁদির পদ পেত শুধু। তার সন্তান হত ঘৃণ্য গ্লানির। এ তো তবু ওর সংসারের গৃহিণীপদ পেয়ে গৌরবের আসনে আছে।
রাজ্যহীন রাজা!
ঘরহীন ঘরণী!
তবু সেই ঘর আঁকড়ে থাকবার দুরন্ত লোভ তো গেলও না সারা জীবনে। ক্লান্ত হয়েছি, নির্লিপ্ত হতে চেষ্টা করেছি, তবু দিদির মতো হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার প্রেরণা সংগ্রহ করতে পারিনি।
এই সময় একদিন এল সেই চিঠিটা!
যা থেকে এল আর এক কলঙ্কিত স্মৃতি।
সেদিন কবে কঘন্টা আগে ছুটির পর শহরে স্কুলে ফিরে গেছে অরুণমাধব।
কদিনের উল্লাস উত্তেজনা উৎসাহের পর বাসাটা যেন দেওয়ালির পরদিনের তেল সলতে জ্বলে যাওয়া মাটির প্রদীপটার মতো পড়ে আছে।
প্রিয়মাধব চলে গেছে কাজে।
তখন চিঠিটা এল। প্রিয়মাধবের নামে।
বৃন্দাবনের ছাপ মারা চিঠি। খামের চিঠি।
কিন্তু কার হাতের লেখা এই ঠিকানা?
মুক্তোর মতো সাজানো অক্ষরে পরিচ্ছন্ন ইংরেজিতে? সাপের ছোবল খাবার মতো শিউরে উঠেই অসাড় হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেই খামে বন্ধ চিঠিখানার দিকে।
কার চিঠি এ? কার চিঠি? আমার চিরপরিচিত এই অক্ষরে কে চিঠি লিখল প্রিয়মাধবকে? বিষে আচ্ছন্ন হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শরীরে সমস্ত রক্ত ঝিমঝিম করে এল, চোখের সামনে থেকে সমস্ত পৃথিবী মুছে গেল, মুছে গেল ন্যায় অন্যায় পাপপুণ্য বোধ! ছিঁড়ে ফেললাম খামের মুখটা। আর ছেঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন ভিতরের চিঠির টুকরোটা বড় বড় দাঁত খিঁচিয়ে ব্যঙ্গ হাসি হেসে উঠল।
প্রিয়মাধবের মার চিঠি!
আঁকা বাঁকা অক্ষরে আর বানান ভুলে ভর্তি। বয়েসের চাপে ক্রমশই বাড়ছে ভুল আর বক্রতা।