ও বলল, বেশি আর কী! চোখের বাইরে থাকবে, কখন কী দরকার হবে বলতে পারবে না।
তুমি যা জামা জুতো কিনলে, বিয়ে পর্যন্ত চলবে ওর!
প্রিয়মাধব গম্ভীর হয়ে বলল, ওই তো একটাই। জীবনে তো ভাগীদার আসবে না ওর!
এই আক্ষেপবাণীর সঙ্গে স্থির গভীর আর হতাশ একটা অভিযোগের দৃষ্টি নিয়ে আমার চোখে চোখ রাখল ও, তারপর আবার বলল, একা ওকে দিয়েই বুভুক্ষা মেটাচ্ছি।
আমি কেঁপে উঠলাম।
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, কী রে খোকা, রেলগাড়ি চড়ে কেমন লাগছে?
গম্ভীর অরুণমাধবের মুখটা আহ্লাদে ভরে উঠল। তারপর বলল, খুব ভাল।
ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন মুক্তি পেয়ে বেঁচে যাচ্ছে।
অথচ এমনটাই কি সত্যি হবার কথা?
মা বাপের এক সন্তান কি থাকে না? তারা কি এইভাবে মুক্তির পিপাসায় অধীর হয়ে ওঠে? অন্তত এই বয়েসে?
তা তো নয়!
আমি অনুভব করলাম ওর মা বাপের মধ্যেকার সম্পর্কের ফাঁকাত্বটাই ওকে এমন কঠিন আর শুষ্ক করে তুলেছে।
ঠিক কিছু না বুঝলেও ও যেন প্রাণরসের স্বাদ পাচ্ছিল না। যান্ত্রিক নিয়মের মধ্যে থেকে হাঁপিয়ে উঠছিল।
অথচ আমিই সংসারের এই যান্ত্রিক নিয়মের কর্তা। আমার সংসারে এতটুকু এদিক ওদিক হবার জো নেই, কারও এতটুকু শৈথিল্য।
ওইটুকুই তো হাতিয়ার।
লড়ে টিকতে হলে একটা কিছু চাই বইকী!
যেদিন ওকে ছেড়ে রেখে চলে এলাম, সেদিন অবশ্য এ দৃঢ়তা থাকল না ওর! প্রিয়মাধব তো কেঁদেই ভাসাল, শুধু আমিই রইলাম দৃঢ় হয়ে।
কিন্তু ভিতরে কি সত্যিই ছিলাম তা?
আমার সামনে ভয়ংকর একটা শূন্যতার হাঁ তাড়া করে আসছিল নাকি?
আমার পিছন থেকে ভয়াবহ একটা ভয়ের হিমস্পর্শ?
তবু অবিচলতা বজায় রাখলাম আমি।
আর আশ্চর্য, বজায় রাখতে রাখতেই সহজ হয়ে গেল সেটা।
ফিরে এলাম শুধু দুজনে।
তার মানে বাড়িতে এখন শুধু প্রিয়মাধব আর আমি!
.
সেই রাত্রে, সেই শুধু দুজনের রাত্রে?
সে রাত্রি আমার জীবন-খাতার একটা কলঙ্কময় ক্লেদাক্ত পৃষ্ঠা। পরে ভেবে অবাক হয়েছি কী করে নিজেকে অমন ছোট করলাম আমি, কী করে অমন অপমান করলাম নিজেকে।
অথচ করেছিলাম!
সারারাত্রি ঘরের দরজা আলগা ভেজিয়ে রেখে জেগে বসে ছিলাম আমি সে রাত্রে। আর প্রতিটি মুহূর্তে অপেক্ষা করছিলাম ও আসবে।
হয়তো ঝড়ের মতো।
সারারাত কণ্টকিত হয়েছি এই উভয়বিধ কল্পনায়। আর হ্যাঁ আর ওই দুই অবস্থার জন্যেই প্রস্তুত করেছি নিজেকে, রচনা করেছি নিজের ভূমিকা। আশায় দুলেছি, আশাভঙ্গে ক্ষিপ্ত হয়েছি। সে যেন সমস্ত রাত্রিব্যাপী এক পাগলিনীর ভূমিকা অভিনয়।
তারপর রাত্রি যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে
শেষ কলঙ্কের কালি মাখলাম নিজের মুখে।
বেরিয়ে এলাম নিজের ঘর থেকে, ওর দরজায় ধাক্কা দিলাম।
একবারেই দরজা খুলে দিল ও।
অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে? শরীর খারাপ?
যদি বলতাম, হ্যাঁ ভীষণ মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে, দেখতে এলাম তোমার কাছে কোনও ওষুধ আছে। কিনা- তা হলে মুখরক্ষে হত!
কিন্তু তা বললাম না।
যে নকল কথাটা ভেঁজে নিয়ে এসেছি, সেটাই বললাম। আর বলার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম, কত বিশ্রি বেমানান খাপছাড়া কথা হল সেটা।
বললাম, হঠাৎ যেন তোমার ঘরে একটা গোঙানির শব্দ পেলাম মনে হল! খারাপ স্বপ্ন দেখেছ?
প্রিয়মাধব আরও অবাক হয়ে বলল, সে কী? না তো! ঘুমই আসছে না। সারারাতই তো জেগে!
আবার আশায় দুলে উঠল বুক!
ভাবলাম, ও তা হলে তোমারও একই দশা! এতই যদি, তবে খোয়ালে না কেন মানটুকু? আমি তো নিজেকে সঁপে দেবার জন্যে বসেই ছিলাম!
কিন্তু মনের কথা তো মুখে বলা যায় না। তাই ভুরু কুঁচকে বললাম, কেন? সারারাত জেগে কেন? শরীর খারাপ লাগছে?
ভাবলাম–এ প্রশ্নের পর ও আর নিজেকে সামলাতে পারবে না, কাণ্ডজ্ঞান হারাবে। শূন্য হৃদয় আর শূন্য ঘরের ভয়াবহতা থেকে ছুটে পালিয়ে আসবে আমার কাছে।
কিন্তু সে ভাবনা লজ্জায় ধিক্কারে মাথা হেঁট করল।
উত্তর নয়, একটা লাঠি বসাল ও আমার মাথার উপর।
ও ম্লান মুখে শিথিল গলায় বলল, না এমনি! মানে খোকাটা কী করল, কোথায় শুল, খেল কি না-খেল ভাবতে ভাবতে
খোকা!
সারারাত বাৎসল্যের আবেগে-ভরা সন্তানবিরহী মন নিয়ে ও জেগে বসে থেকেছে।
আর আমি?
আমি খোকার অনুপস্থিতিটাকে সুযোগ ভেবে নিয়ে ভিতরের অবরুদ্ধ সাপের ঝাঁপিটার মুখ খুলে দিয়েছি, আর ছড়িয়ে পড়া সাপগুলোকে নিয়ে খেলাচ্ছি!
একটা নীচ নোংরা মেয়েমানুষের মতো বাৎসল্য স্নেহের মধুর আবেগ, সন্তান বিরহের পবিত্র বেদনা খুলে, কামনায় উত্তাল হয়ে উঠেছি।
.
মাথা হেঁট করে ফিরে এলাম।
ঘরে এসে আছড়ে আছড়ে মারলাম সেই ক্লেদাক্ত সাপগুলোকে। চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেললাম, ধুলো ধুলো করে দিলাম তাদের বহুতর কঠিন প্রতিজ্ঞার ঝাঁপটে।
নতুন জন্ম নিয়ে নতুন সকালের বাতাসে শ্বাস নিলাম।
আশ্চর্য রকমের বদলে গেলাম। হ্যাঁ বদলে গেলাম। মদ্যপ চরিত্রহীন প্রিয়মাধবকে নিজের থেকে উঁচু ভাবতে শুরু করলাম সেদিন থেকে। প্রতিটি কথায় ছোবল হানা থেকে বিরত হলাম।
আর বাসনার তিক্ততাকে সরিয়ে রাখতে রাখতে ওর সত্যিকার হৃদয়ের খোঁজ পেলাম। দেখলাম ওর ভালবাসার প্রাণটি ভরা আছে সুমিতাকে দিয়ে। টের পেলাম এই এতগুলো বছর, ও লুকিয়ে লুকিয়ে অবিরতই সুমিতার খোঁজ করেছে।
অথচ আশ্চর্য, আমি যখন নিশ্চেষ্ট বলে শত ধিক্কারে লাঞ্ছিত করেছি ওকে, ও নীরবে সে লাঞ্ছনা মাথা পেতে নিয়েছে।