আমি হাসি, পেতনি যে! যারা মরে গিয়েও চলেফিরে বেড়ায়, জ্যান্ত মানুষরা তাদের ভয় করে।
প্রিয়মাধব বলে, তোমার ওই আলমারির চাবি হস্তগত করে একদিন পুরো বোতল গলায় ঢেলে মাতলামি করব দেখো।
আমি সংক্ষেপে বলি, দেখব।
এমনি চলতে চলতে খেয়াল হল অরুণকে এবার মানুষ করে তোলার চেষ্টা দরকার, ভাল স্কুলে দেওয়া দরকার। কিন্তু এখানে কোথায় সেই ভাল স্কুল?
প্রিয়মাধব প্রথমে হেসে ওড়াল। বলল, কেন, এক্ষুনি ছেলে পড়ানোর দায়িত্ব ত্যাগ করতে চাও কেন? তোমার বিদ্যেয় আর কুলোচ্ছে না খোকার?
বললাম, কুলোচ্ছে না-ই তো। আমার আবার বিদ্যে কোথায়?
বাঃ ম্যাট্রিক পাস করেছিলে না তুমি?
সে সব তামাদি হয়ে গেছে।
আবার বানাও।
বললাম, না না, স্কুলে না পড়লে পড়ার মনোভাব আসে না। তা ছাড়া ওর মনটাও তো দেখতে হবে? কতখানি নিঃসঙ্গ ও, তা ভাবো তো!
সত্যিই খোকার নিঃসঙ্গতার দিক থেকে চিন্তা করেই স্কুল স্কুল করে ব্যস্ত হয়েছিলাম আমি। নইলে বছর আষ্টেকের ছেলেটাকে আরও কিছুদিন পড়ানো হয়তো আমার পক্ষে শক্ত ছিল না।
কিন্তু নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা আমি বুঝতাম।
সেই ভয়াবহ যন্ত্রণা, যা আমার উপর তার দাঁত বসিয়েই রেখেছে, আর প্রতিক্ষণ সেই দাঁতের চাপে কেটে কেটে খাচ্ছে আমায়, সেই যন্ত্রণাই যে উঠছে ক্রমশ বড় হয়ে ওঠা খোকার মধ্যে, এ আমি অনুভব করছিলাম। তাই
নিজের বিদ্যেকে নস্যাৎ করে দিয়ে বললাম, তা ছাড়া আমাদের আমলের পড়া আবার পড়া ছিল নাকি? তাও আবার মেয়ে স্কুলের।
পাস তো করেছিলে ইউনিভার্সিটিতে? বলল প্রিয়মাধব।
সেও মেয়ে বলে করুণায়। জানো না তখন মেয়ে বলে খাতায় বিশেষ একটা চিহ্ন থাকত!
এই কথার হাওয়ায় তখনকার মতো হয়তো হাওয়া হালকা হয়ে যেত, কিন্তু আমি জেদ ছাড়লাম না। আমি বদ্ধপরিকর।
আবার সে কথা তুলতাম।
প্রিয়মাধব আবারও বলত, এখন বলছ, দেখো ওকে পাঠিয়ে দিয়ে তুমি টিকতে পারবে না।
বলতাম, কেন? আমাকে কি খুব একটা হৃদয়বতী বলে মনে হয়?
হয় বইকী! শুধু একজনের ক্ষেত্র বাদে।
সব ক্ষেত্রেই সমান। বিধাতা পুরুষ আমার মধ্যে ওই হৃদয় নামের বালাইটা দেননি। খুব সম্ভব যমজের ভাগ করতে করতে ভুলে দুটো ভাগই একই অংশে দিয়ে ফেলেছিলেন।
প্রিয়মাধবকে পাংশু দেখাত এ ধরনের কথায়, পারতপক্ষে ও দিদির কথা তুলত না, শুধু এ ধরনের কথায় স্নান গলায় বলত, তার প্রমাণই বা রইল কই? অনায়াসেই তো খোকাকে ফেলে
আমি ঝংকার দিয়ে বলতাম, অনায়াসে কি অনেক আয়াসে, তা জানো তুমি?
ও বলত, কী জানি, হয়তো তাই।
এইসব সময় আমি আবার দিদিকে খোঁজার কথা তুলতাম। ধিক্কার দিতাম, কটুকথা বলতাম।
ও অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে চুপ করে থাকত।
কিন্তু কেন আমি ও রকম করতাম?
সত্যিই কি চাইতাম দিদি ফিরে আসুক।
কোনওদিনই কি চেয়েছি?
না, চাইনি। যদি চাইতাম তা হলে সত্যিই যখন ধূসর একটা আশ্বাসবাহী খবর এল, তখন অমন ভয়ানক নিষ্ঠুর পাপটা করে বসতাম না।
তবে খবরটা তখন আসেনি।
যখন অরুণকে বোর্ডিঙে দেওয়ার কথা চলছে, তখন সেই পাপের স্পর্শ লাগেনি আমার গায়ে।
তখন শুধু উৎখাত করছি প্রিয়মাধবকে। ছেলের শিক্ষা আর নিঃসঙ্গতার জন্যেও নয়। হয়তো ও বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক একটা ভয়ের সৃষ্টি হচ্ছিল মনের মধ্যে। যদি ও আমাদের দুজনের ভিতরকার সম্পর্কটার ফাঁকি ধরে ফেলে? যদি সে রহস্য উদঘাটনে যত্নবান হয়?
এর পর প্রিয়মাধব বলল, অরুণ তোমায় ছেড়ে থাকতে পারবে না।
বললাম, আমায় না তোমায়?
আমার থেকে তোমাকে অনেক বেশি ভালবাসে, বলল প্রিয়মাধব।
আমি অগ্রাহ্যের হাসি হাসলাম।
বললাম, তা হয় না। প্রকৃতির নিয়ম তা বলে না। রক্তমাংসের যোগ, নাড়ির যোগ, এটা সহজাত আকর্ষণের। আমার সঙ্গে ওর কোথায় কীসের যোগ?
ও বলল, একেবারেই কি নেই? যমজরা তো শুনেছি ভিন্নদেহে অভিন্ন। সেই পথ ধরেই ।
থামো! বাজে বোকো না। ও কোনও কথাই নয়। খোকা আমার চেয়ে অনেক বেশি ভালবাসে তোমাকে।
বেশ তবে না হয় বলছি–আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবে না ও।
আমি তখন অরুণমাধবকেই ডাকলাম।
হেসে বললাম, কী রে, বোর্ডিঙে রেখে পড়াতে চাইলে পড়বি না তুই? আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবি না বলে কাঁদবি?
অরুণমাধব লজ্জায় লাল হয়ে বলল, যা!
বাপের মতো বাঁচাল হয়নি ছেলেটা, মায়ের মতো স্বল্পভাষী হয়েছে। তাই ওইটুকুর বেশি কিছু বলল না।
প্রিয়মাধব রেগে বলল, তোমার প্রশ্নপত্রেই কারসাজি। আমি হলে ওভাবে প্রশ্ন করতাম না।
কীভাবে করতে তুমিই বলো–বললাম নিরীহ গলায়।
আমি বলতাম, কী রে খোকা, আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবি তো? নির্ঘাত ও উত্তর দিত, না পারব না। আমি যাব না।
বেশ তুমিই জিজ্ঞেস করো।
আর হয় নাকি? ও সব শুনে নিল।
অরুণমাধব এবার হঠাৎ নিজে থেকে বলে উঠল, ইস্কুলে অনেক বন্ধু থাকবে তো!
অর্থাৎ সেই অনেক বন্ধুর বিনিময়ে কিছু ত্যাগস্বীকার করতে সে প্রস্তুত আছে।
আর প্রিয়মাধবের আপত্তি টিকল না।
বাগান থেকে কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে শিলঙে চলে এল প্রিয়মাধব আমাদের সঙ্গে করে। সেখান থেকে ছেলের স্কুল আর বোর্ডিঙের সুব্যবস্থা করে ফিরল।
প্রচুর খরচ করল, প্রচুর জিনিস কিনল প্রিয়মাধব, আমার বকুনিতে কান দিল না। আমি যত বলি, বোর্ডিঙে আরও ছেলে থাকবে, তাদের সঙ্গে যাতে সমান হয় সেই তত ভাল। অত বেশি বস্তুর ভার চাপাচ্ছ কেন?