আমি কি তবে আত্মহত্যা করব?
আত্মহত্যা!
আশ্চর্য! এই শব্দটা চিরদিন আমাকে আশার গান শোনাল, আমাকে সোহাগের হাতছানি দিল, আমাকে মুক্তির দরজা দেখিয়ে দেবার অঙ্গীকার করল, অথচ ওর শরণাপন্ন হলাম না আমি। আমি শুধু ওকে যখন ইচ্ছে ভোগ করব এই মনোভাব নিয়ে আদরে লালন করলাম। কিন্তু ভোগ করলাম কই?
আমার ভাগ্যবিধাতা আমার ভোগের ঘরটা শূন্য রেখেছিল বলেই কি ওই কী যত্নে লালিত বস্তুটাও ভোগ করা হল না?
নইলে কেন আমি ওই আত্মহত্যা নামের মধুর আশ্বাসবাহী সোহাগের হাতছানি দেওয়া প্রেমিকের কাছে ধরা দিলাম না? সারাজীবন শুধু ওর ডাককে সরিয়েই রাখলাম।
প্রাণের মায়া কি আমার বড় বেশি?
কই, তাও তো মনে হয় না।
নিজের দিকে যুক্তি খাড়া করতে থোকাকে সামনে খাড়া করেছি, ভেবেছি কারণ খোকা। দিদিকে যদি খুঁজে পাওয়া যায়, তন্মুহুর্তেই আমি গলায় দড়ি পরিয়ে ঝুলে পড়তে পারি।
হ্যাঁ, বহুকালাবধি দিদিকে খুঁজে পাওয়ার কথা ভেবেছি আমি। যদিও প্রিয়মাধব সব সময় বলত, সে এ পৃথিবীতে নেই! সে আর আসবে না। বলত, সে স্বর্গের দেবী ছিল স্বর্গে চলে গেছে।
কিন্তু আমার আশা ছিল, দিদি আসবে।
আমার ভয় ছিল, দিদি আসবে।
এই ভয় আর আশা নিয়ে জীবন কাটিয়েছি আমি। সব দিকেই ভয় আর আশা।
প্রিয়মাধবকে নিয়ে ঘর করছি ভয় আর আশা, অরুণমাধবকে নিয়েও ভয় আর আশা। হ্যাঁ অরুণকে নিয়েও সেই দ্বন্দ্বদোলা।
ও হয়তো সত্যিই মা মনে করছে আমায়। ও হয়তো বুঝতে পারবে আমি ওর মা নই।
আমার ছদ্মবেশ ধরা পড়ে গেলে ও হয়তো আমাকে ঘৃণা করবে। আমার যন্ত্রণা টের পেলে হয়তো ও আমায় মমতা করবে।
এই জীবন আমার!
আনাড়ি এক মাঝির নৌকোয় চড়ে বর্ষার গঙ্গায় খেয়া পার হওয়া যেন! নৌকোর কানা চেপে ধরে ভাবনা, ডুবল বুঝি, ডুবল বুঝি।
কিন্তু প্রিয়মাধব যেন ক্রমশ সুস্থ হতে লাগল। ওর সেই বিকৃত জীবনটা যেন আর একটা সত্তায় ভর করে রইল ঘরের বাইরে, পারিবারিক গণ্ডির বাইরে, ঘরের ভিতরকার মানুষটা বিরাজ করতে লাগল আর একটা সত্তায়।
আর ক্রমশই আগের মতো হাসিখুশি হতে থাকল, অরুণমাধবকে কেন্দ্র করে চলতে লাগল এই অদ্ভুত সম্পর্কের দুটি নরনারীর সংসার।
আরও বার দুই বাগান বদল হল প্রিয়মাধবের। নতুন নতুন পরিবেশে একেবারে মেমসাহেব হয়ে গিয়ে দিব্যি মানিয়ে গেল নতুন মেমসাহেব।
নমিতা সুমিতার খোলসটাই শুধু আঁটল। সুমিতা হতে পারল না। তবু নমিতার উপর রাগ করল না প্রিয়মাধব। যেন মনকে মানিয়ে নিল। চার আনা বাদ দিয়ে বারো আনাতেই সন্তুষ্ট থাকতে শিখল।
তাই অরুণমাধব জ্ঞানাবধি শুনতে লাগল, সুমিতা, সুমিতা, সুমিতা।
সুমিতা, দেখ তোমার ছেলের কাণ্ড, সুমিতা, দেখ তোমার ছেলের বুদ্ধি, সুমিতা, দেখ তোমার ছেলের দুষ্টুমি!
সুমিতার সংসার, সুমিতার ছেলে, সুমিতার স্বামী!
যা কিছু হিংসের ছিল আমার, সবই পেলাম আমি।
কিন্তু এই কি পাওয়া?
আমি যদি সুমিতার সঙ্গে লড়াই করে জিতে নিতে পারতাম তার ঐশ্বর্য, সে পাওয়ায় হয়তো শান্তি ছিল না, তবু গৌরব ছিল।
এ পাওয়ায় আছে কী?
সুমিতার ঘৃণাভরে ত্যাগ করে যাওয়া ছেঁড়া জুতো মাথায় করে বইব আমি ঐশ্বর্য বলে!
এই ঘৃণা সুমিতার ঐশ্বর্যকে ভোগ করতে বাধা দিয়েছে আমায়, এই ঘৃণা আমাকে কিছুতেই সুমিতা হতে দেয়নি।
না, সুমিতা হতে পারলাম না আমি। সুমিতা হারিয়ে গেল। নমিতা মরে গেল।
আর ওই দুটো শবদেহের ভেলায় চড়ে অদ্ভুত একটা প্রাণী সংসার ঠেলতে লাগল। ছেলে মানুষ করে তুলতে লাগল।
.
কম বয়সে কবিতা লিখেছি।
সুমিতার চা বাগানের সংসারেও লিখেছি।
এখন সে কথা ভাবলে অবাক লাগে।
আরও অবাক লাগে ভেবে, এত কথা আমি লিখছি কেন?
আমি কি আমার বোনের ছেলে অরুণমাধবের কাছে সাফাই গাইতে চাইছি?… না, শুধু যন্ত্রণার কবল থেকে মুক্ত হবার আর কোনও উপায় পাচ্ছি না বলেই?
লোকে বলে, মিসেস মুখার্জি, প্রিয়মাধব বলে, সুমিতা।
আমিও সুমিতার গয়না, কাপড়, আসবাব, শখের জিনিস, সব কিছু দখল করে দেখি সুমিতা হতে পারি কিনা।
মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়তো হয়ে গেছি।
যখন অরুণমাধব মা বলে ছুটে আসে, সব আদর আবদার জানায়, বাপের নামে নালিশ করে, কিছুতেই মনে হয় না, আমি বিধবা নমিতা, আমি মৃত হেমন্ত উকিলের বউ।
আর তখনই মনে হয়, এই সুমিতা হয়ে যাওয়া মনটাকে সেই হেমন্ত উকিলের স্ত্রীর দেহে আটকে রেখে লাভ কী হল আমার? আমার মনটা তো ধীরে ধীরে সুমিতা হয়ে এল, দেহটাকেই বা আগলে রেখে হল কী?
কিন্তু এখন আর সে আক্ষেপে লাভ নেই।
এখন প্রিয়মাধব নামের এই অশান্ত প্রাণীটা ঘোলা জলে তার পিপাসা মেটাবার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। এখন তার কাছে ঠাণ্ডা শরবতের গ্লাস বাড়িয়ে ধরতে যাব কি আমি?
সে হয় না।
আমি শুধু মিসেস মুখার্জি।
আমি শুধু সুমিতা।
আমি অরুণমাধবের মা।
প্রিয়মাধবের বউ নই আমি।
আমার এই অদ্ভুত জীবন নিয়ে চরেও তো বেড়াচ্ছি দিব্যি। প্রিয়মাধবের সব পরামর্শ আমার সঙ্গে, প্রিয়মাধবের টাকাকড়ি সব আমার হাতে, প্রিয়মাধবের নেশার বস্তু আমার সামনে।
আমি মেপে দিয়ে বলি, আর নয়! ক্রমশই বাড়াবার তাল তোমার, অত আহ্লাদ চলবে না।
আমি বাড়ি থেকে বার করে দিয়ে বলি, বারোটার মধ্যে ফেরা চাই,–চাই। বলছি, রাত কাবার করলে দেখাব মজা।
প্রিয়মাধব বলে যায়, মজাটা কেমন জিনিস এক আধদিন দেখতে সাধ হয়। কিছুতেই কেন সাহস হয় না বলো তো?