বলত, পাশাপাশি ঘর, তবু এ ঘরটা এমন মোলায়েম গরম, আর ও ঘরটা অমন হিম হিম ঠাণ্ডা মনে হয় কেন বলো তো?
আমি খোকার জন্যে সোয়েটার টুপি কি মোজা বুনতে বুনতে নির্লিপ্ত গলায় বলতাম, ইচ্ছে হয় ঘরটা বদলে নিতে পারো। বলো তো কালই চাকরদের দিয়ে খাট বদলে নেব।
ও বলত, কী নিষ্ঠুর!
তারপর বলত, আচ্ছা জগতে শুধু শপথই আছে, তার কাটান আর কিচ্ছু নেই?
আমি বলতাম, থাকবে না কেন? না মানলেই কাটান! পশুপক্ষী জন্তু জানোয়ারের তো আবার শপথেরও বালাই নেই।
হ্যাঁ, এইভাবে প্রতিনিয়ত অপমান করতাম ওকে। আমার সমস্ত ব্যর্থতা, সমস্ত যন্ত্রণা, সমস্ত ক্ষুধা, ওর উপরেই গিয়ে আছড়ে আছড়ে পড়ত পাথরের গায়ে নদীর ঢেউয়ের আছড়ানির মতো।
ধাক্কায় ধাক্কায় ক্রমশ বিকৃত হতে থাকল ও। ২৯৬
কিন্তু আমি?
যে আমি নমিতাও নই, সুমিতাও নই। হয়তো বা কিছুই নই।
আমি অবিকৃত থাকছি?
এখন যে আর ছেলের অসুখ করলে রাত জাগতে প্রিয়মাধবের সঙ্গে একসঙ্গে রাত জাগা চলবে না, একথা তো আমাকেই বলতে হবে?
ছেলের সূত্র ধরে ঘনিষ্ঠতার সীমারেখা লঙ্ঘন করতে এলে ওকে অপমান আমাকেই তো করতে হবে?
আর ও যখন হতভাগ্যের মতো আমার পায়ের কাছে বসে পড়ে বলবে, তোমায় তো আমি সুমিতা ছাড়া আর কিছু ভাবছি না নমিতা, তবে কেন তুমি এমন মুখ ফিরিয়ে থাকবে?
তখন তো আমাকেই বিদ্রুপের হাসি হেসে বলতে হবে, জীবনটা নাটকভেল নয়!
তবু নাটকনভেলের মতোই করেছে প্রিয়মাধব।
দিনের পর দিন আমার কাছে এসে আছড়ে পড়েছে, তুমি সুমিতা হও, তুমি সুমিতা হও, নমিতা! তুমি তো আমায় চিরদিন ভালবেসে এসেছ, আমি তো তোমার মন জানি, তবে এত দ্বিধা কেন তোমার? তোমার চিরদিনের অপূর্ণ জীবন পরিপূর্ণ করে তোলো তুমি সুমিতার পানপাত্রে।
আমি কি কেঁপে উঠতাম?
আমার শিরায় শিরায় রক্তধারা কি উন্মাদ হয়ে উঠত না? আমার কি মনে হত না, কী লাভ আমার এই মিথ্যা মর্যাদার ভানে? চিরদিন যে স্বর্গের দিকে জ্বালাভরা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে এসেছি, সে স্বর্গ যদি হাতের মুঠোয় আসতে চায়, কেন নেব না আমি?…
মনে হত।
তবু আমার চিরদিনের অহমিকা আমার সেই ভোগের পাত্র ধরতে যাবার বাড়ানো হাত চেপে ধরত। আমি ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলতাম, হ্যাঁ, সুমিতা দেবীর ফেলে দেওয়া পানপাত্র।
৫. অন্য সুর
এরপর প্রিয়মাধব অন্য সুর ধরেছিল। বলত, স্বাভাবিক জীবন থেকে চ্যুত হয়ে স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার। প্রকৃতির প্রতিশোধ হঠাৎ একদিন কিছু একটা কঠিন রোগে না পড়ে যাই।
আমি কটু হতাম।
বলতাম, এ অঞ্চলে স্বাস্থ্যরক্ষার ওষুধের তো অভাব নেই। খুঁজতে হবে না, ইচ্ছে করলেই মিলবে। প্রিয়মাধব এই কটু কথায় আহত হত।
দু-চারদিন চুপ করে থাকত।
কিন্তু আসামের ওই ভয়ংকর বর্ষার রাতগুলো কি চুপ করে ঘুমিয়ে থাকবার?
আমিই কি পেরেছি চুপ করে ঘুমিয়ে থাকতে?
জেগে উঠতাম।
ভয়ংকর কিছু একটার প্রতীক্ষা করতাম। মনে হত বাজ পড়বে, সব জ্বলে খাক হয়ে যাবে।
কিন্তু পড়ত না সেই বাজ।
শুধু দরজার বাইরে দ্রুত পদধ্বনি আরও দ্রুত হত।
.
তারপর একদিন, খোকা তখন বছরখানেকের, সেই বাজ পড়তে এল। দরজার কাছে পায়ের শব্দ থামল। দরজায় ধাক্কা পড়ল।
সুমিতার খোলস সেই ধাক্কার আঘাত সইতে পারল না। প্রিয়মাধবের স্ত্রী সেজে প্রিয়মাধবের সন্তানকে নিয়ে যে শুয়ে রয়েছে, সে সহসা বিভ্রান্ত হল।
দরজা খুলে ফেলল।
বলল, কী? কী চাই?
প্রিয়মাধব বলল, আর কিছু শুনতে চাই না, তোমায় চাই। তোমায় সুমিতা করে নিতে চাই। নমিতা তো মরে গেছে। তবে নমিতার ভূত সুমিতাকে আগলে থাকবে কেন?
সুমিতার খোলস সেদিন ওই কেনর উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না। সে শুধু বলে উঠেছিল, তোমার পায়ে পড়ি। তোমার পায়ে পড়ি। তোমার পায়ে পড়ি।
সেই ভয়ংকর মুহূর্তে সুমিতার খোলসকে রক্ষা করল সুমিতার ছেলে। সুমিতার ছেলে বোধ করি হঠাৎ ঘরের মধ্যে নতুন কণ্ঠস্বরে চমকে জেগে উঠল। জেগে উঠে পরিত্রাহি কান্না ধরল।
শিশুও বোধ করি পশুর মতো ভাবী অমঙ্গলের ছায়া দেখতে পায়। অকল্যাণ থেকে সাবধান করবার চেষ্টা করে সহজাত শক্তিতে।
অরুণমাধবের সেই কান্নাটা না হলে সে রাত্রে অমন অস্বাভাবিক হয়েছিল কেন? কাঁদতে কাঁদতে তড়কা হয়ে গিয়েছিল কেন?
তারপর থেকে আছড়ানি থামল প্রিয়মাধবের। ধীরে ধীরে বোধ করি স্বাস্থ্যরক্ষার সহজ পথ বেছে নিল সে।
.
কিন্তু প্রথম প্রথম ওর সেই ভয়ংকর সহজটা সহ্য করে নিতে আমি যে যন্ত্রণা ভোগ করেছি সে কি লিখে উঠতে পারব আমি?
আমি দেখছি–চোখ মেলে দেখছি, প্রিয়মাধব বাগানের পিছনের ঘরটায় কোনও একটা দেহাতি মেয়েকে নিয়ে আসছে, দেখছি প্রিয়মাধব অনেক রাত্তির পর্যন্ত বাইরে কাটিয়ে মত্ত অবস্থা বাড়ি ফিরছে, দেখছি প্রিয়মাধব সকালবেলা মানের আগে খোকাকে ছুঁচ্ছে না।
দেখছি বুঝতে পারছি প্রিয়মাধব হৃদয় বেদনায় কাতর হয়ে হৃদয় খুঁজতে বেরোচ্ছে না, ওর যন্ত্রণা নিছক স্থূল। তাই নীচ সংসর্গ করছে প্রিয়মাধব। অসহ্য জ্বালা নিয়ে সহ্য করছি সেই বুঝতে পারা।
বারণ করব কোন মুখে?
ধিক্কার দেব কোন ভাষায়?
ওকে এ রাস্তার পথ দেখিয়ে দিয়েছি তো আমিই। আমি ওকে আছড়ে ভেঙে চুর করলাম, নতুন মূর্তিতে গড়তে পারলাম না। দিদির মন্দিরের দেবতাকে রাস্তার ঢেলা করে ফেলে দিলাম আমি।