তবে তারপরে ওর গলার স্বরটা শুনতে পেয়েছিলাম। ক্ষুব্ধ আহত দুঃখী মানুষের মতো।
খেয়েছি! না খেয়ে কী করব? আমাকে তো বাঁচতে হবে!
আমি বলে উঠলাম, বাঁচবার জন্যে বিষের শরণ? বাঃ বেশ চমৎকার! নিজের সেই ক্ষণপূর্বেরক্ষণিক দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলার গ্লানি আবার ওর উপরই ছোবল হানতে চাইল। বললাম–মনে হচ্ছে এমনই একটা নাটকীয় জীবনই তোমার কাম্য ছিল। দিদি সরে গিয়ে পথ পরিষ্কার করে দিয়ে গেল।
হঠাৎ প্রিয়মাধব একটা অপ্রত্যাশিত তীব্র চিৎকার করে উঠল, চুপ! আর একবারও যেন শুনতে না হয় ও নাম। দিদি, দিদি, দিদি! দিদি বলে কেউ নেই, কোনওদিন কেউ ছিল না বুঝলে? তুমি সুমিতা, আমার বিবাহিতা স্ত্রী! তুমি তোমার বাবার একমাত্র মেয়ে। যমজ বোন বলে কিছু ছিল না তোমার।
আমি আমার ফণা বার করলাম।
বললাম, তা বটে। তা হলেই নিষ্কণ্টক সুখ সুবিধেটা জোটে। তাই না? বিধবা শালি তবু ভয়ের, বিবাহিতা স্ত্রীকে যা খুশি করা যায়–
ও আহত হয়ে বলল, আমার সাহস ছিল না! তুমিই
কথাটা সত্যি।
কিন্তু সেই সত্যি কথাটা মেনে নেওয়া তো মস্ত পরাজয়। তাই গম্ভীরভাবে বলালাম, একবার বাজিয়ে নিলাম!
বাজিয়ে নিলে?
হ্যাঁ! দেখলাম টাকাটা খাঁটি না মেকি।
কী দেখলে? মেকি?
তা আবার বলতে। বললাম আমি নিষ্ঠুর গলায়, স্রেফ দস্তার টাকা। ছি ছি! এই নিয়েই এত বড়াই ছিল দিদির!
আর যদি তোমার কথা বিশ্বাস না করি? যদি বলি ওই বাজিয়ে নেওয়া বানানো।
বলো। বলতে তো পয়সা লাগে না। ভগবান মুখ দিয়েছে বলবার জন্যে।
ওকে অপদস্থ করতে করতেই নিজের শক্তি ফিরে পাচ্ছিলাম ক্রমশ, তাই ওকে ছাড়লাম না। শেষ পর্যন্ত ওকে ধিক্কারে জর্জরিত করে খোকার মাথায় হাত দিইয়ে শপথ করালাম কোনওদিন আমার দিকে হাত বাড়াবে না।
ও মন্ত্রাহতের মতো করল সেই শপথ। প্রথম মদের নেশা ওকে আবেগে উত্তাল করে তুলেছিল, তাই যখন মোড় ঘুরল, তখন ভাল করেই ঘুরল।
তবু পরে বলেছিল, আর নমিতা, যদি তুমি নিজে না পারো?
ভুরু কুঁচকে বললাম, বটে? তা বেশ তো, তেমন অপারগ অবস্থা হয়, নিজে এসেই তোমার শরণ নেব।
আর আমি যদি শপথ না রাখতে পারি? আমি তো আজ মাতাল হয়েছি, মাতালের শপথের মূল্য কী?
মনে রেখো খোকার কল্যাণ অকল্যাণ এতে জড়িত।
ও চুপ করে গেল।
মনে হল যেন শিউরে উঠল।
আমি পরিস্থিতি হালকা করতে, প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলাম। বললাম, সাহেবদের ক্লাব থেকে তো বেশ ভাল জিনিসই খেয়ে এসেছ, সারাদিনের উপোসের পারণ হয়ে গেছে বোধহয়?
ও চমকে বলল, সারাদিন? ওঃ তাই তো! তুমিও খাওনি?
আমি ভাঙব তবু মচকাব না।
আমি আমার সেই ক্ষণিকের দুর্বলতার শোধ তুলব! তাই আমাকে বলতে হল, কেন আমি খাব না। কেন? ম্যানেজার সাহেবের স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করছি বলে কি সত্যিই হিন্দুবিবাহের পতিব্রতা-স্ত্রী হয়ে গেছি নাকি?
খেয়েছ? তবু ভাল। আমি মানে কিছু খাব না। হয়ে গেছে কিছু খাওয়া দাওয়া। রবার্ট সাহেবকে পাওয়া গেল, তারই আহ্লাদে খানাপিনা হল–
কোথায় পাওয়া গেল সাহেবকে, কৌতূহল হলেও, সে প্রশ্ন করলাম না আমি। আমার সারাদিনের উপবাসক্লিষ্ট দেহ ওর এই নির্লজ্জ স্বীকারোক্তিতে যেন দপ করে জ্বলে উঠল। তাই আবার বিষদাঁত বসালাম।
বললাম, বাঃ চমৎকার! একেই তো বলে পুরুষ! মেয়ে হলে স্বামী বিয়োগে বাকি সারাজীবন হবিষ্যি করে মরত! আর এ দেখ মাত্তর কাল জলজ্যান্ত বউটা হারিয়ে গেল, আর সাহেব আজ খানাপিনা করে টগবগ করতে করতে এলেন যদি আরও কিছু লোভনীয় খাদ্য জোটে এই আশায়।
ও বলল, নমিতা, জানতাম তুমি নিষ্ঠুর। কিন্তু এত নিষ্ঠুর তা জানতাম না।
প্রথম দিনের ইতিহাস এই। ও বলল, জানতাম না তুমি এত নিষ্ঠুর!
.
কিন্তু আমিই কি ছাই জানতাম আমি এত নিষ্ঠুর!
ও তো বারে বারেই ভেঙে পড়েছে, বারে বারে বলেছে, নমিতা, মুখের শপথটাই কি সব? তুমি কি বুঝতে পারছ না আমি আর পারছি না!
আমি খোকার মাথায় হাত দেবার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। অথচ প্রতি মুহূর্তে কামনা করেছি ও ওর শপথ ভাঙুক! ও বন্য হয়ে উঠুক, পশু হয়ে উঠুক।
আমি জানি না কে আমার মধ্যে বসে থেকে আমাকে সমস্ত সুখের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করেছে। আমার তৃষ্ণার জলের পাত্র মুখের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছে।
সে কি দিদি?
না আমার আজন্মসঞ্চিত সংস্কার?
না কি বিবেক?
বিবেক-টিবেককে আমি বিশ্বাস করি না, মনে হয় দিদিই তার অশরীরী আত্মার ভার দিয়ে আমাকে গ্রাস করে রেখেছে চিরদিন। দিদির সেই চোখকে আমি কোনওদিন উপড়ে ফেলতে পারিনি।
সে চোখ অহরহ আমার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে পাহারা দিয়েছে। খোকাকে কোনওদিন এতটুকু অযত্ন করে ফেললে মনে হয় সেই চোখ ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলছে, কেন? এখন কেন? খুব যে কেড়ে নিয়েছিলে?
আর যখন প্রিয়মাধবকে ফিরিয়ে দিই?
তখনও কেন সেই চোখ স্নিগ্ধ হয় না, কোমল হয় না? তখনও কেন আরও তীব্র ব্যঙ্গের ছুরি উঁচিয়ে বলে, সে কী? কেন? আর তো কোনও বাধা নেই। চিরদিনের সাধ মিটিয়ে নিচ্ছ না কেন?
হ্যাঁ ফিরিয়ে দিতে হত প্রিয়মাধবকে।
প্রায় প্রতিদিনই।
রাত্রে শুতে যাবার আগে খোকাকে দেখবার ছুতোয় ও আমার ঘরে এসে আর উঠতে চাইত না, এটা ওটা কথায় সময়কে ঠেলে ঠেলে দিত। তারপর একটুখানি ভিখিরির হাসি হেসে বলত, ঘরটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।