ধরে নিন কলকাতা থেকে খবর এসেছে পৌঁছয়নি সেখানে। পথের মাঝখানে অথবা পথের প্রথমেই কোথাও হারিয়ে গেছে।
লোকে হাসবে মুখ ফিরিয়ে। বলবে বয়েসটা অবশ্য হারানোরই মতো। রূপটাও কম যায় না।
তা হলে দিদি সত্যিই মুছে যাবে?
যদি তার ভুল ভাঙে, অভিমান ভাঙে, যদি নিজে থেকে এসে
ওর কথা থামিয়ে তীব্র স্বরে বলেছিলাম, এ বিশ্বাস আপনার আছে?
ও কেঁপে উঠল।
বলল, ভাগ্যের কাছে প্রার্থনা করছি। তারপর হঠাৎ বলে উঠল, সর্বনাশ, কত দেরি করে ফেললাম, এক্ষুনি বেরোতে হবে, দেখি ভেবে।
সাজপোশাক করে ছুটে বেরিয়ে গেল ও, আর বেরিয়ে পড়বার পরই বিছানায় আছড়ে পড়লাম। আমি, ও যে সকাল থেকে কিছু খায়নি, সেটা মনে পড়ল ও বেরিয়ে যাবার পর। মনে হল ওর পিছু পিছু ছুটি, ওকে পায়ে ধরে ফেরাই।
আশ্চর্য, ওকে আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতে ইচ্ছে করে, অথচ ওর জন্যে নিজের প্রাণ এমন বিদীর্ণ হতে চায় কেন? চিরজীবন ওর সঙ্গে এই সম্পর্ক থাকল আমার। ওকে জড়িয়ে ধরতে প্রাণ শত বাহু মেলে এগিয়ে যেতে চায়, আবার ওকেই ছোবল হানবার জন্যে জিভ যেন উগ্র ক্ষুধায় উন্মুখ হয়ে থাকে।
.
সেদিন অনেক রাত্রে ফিরল ও।
সারাদিন আমিও অভুক্ত থেকেছি, কিন্তু যেমন করে বিছানায় পড়ে থাকতে ইচ্ছে হয়েছিল, ওকে সেই অভুক্ত অভিমানহত মূর্তিটা দেখাতে বাসনা জাগছিল তেমন আর হল কই? দিদি যে লোহার শিকল পরিয়ে দিয়ে গেছে আমার গলায়। খোকার জন্যে উঠতে হয়েছে আমায়, সবই করতে হয়েছে।
নিজের কাছে অস্বীকার করব না, সেই বাধ্য হয়ে করার বিরক্তিতে খোকার উপর ভয়ানক একটা আক্রোশ অনুভব করেছি সেদিন, অবাক হয়ে ভেবেছি এই বিরক্তিকর বস্তুটাকে নিয়ে দিদির সঙ্গে হারজিতের খেলা খেলে মরেছি আমি? দিদিকে মেরেছি সেই খেলার রেজাল্টে!…
কেন?
দিদি থাকতে খোকার সব কাজই আমি করেছি, কিন্তু তা কাজ বলে মনে হয়নি। ফুলের মতো পাখির পালকের মতো বাতাসের মতো হালকা সেই কাজের ভার অবলীলায় বহন করেছি। কিন্তু দিদিহীন শূন্য বাড়িটায় খোকার ভার যেন পাহাড়ের ভার হয়ে উঠছে।…এ ভাব কাটিয়ে উঠতে অনেকদিন লেগেছিল।
সেদিন ও ফিরল অনেকটা দেরি করে।
সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় অত রাত পর্যন্ত একা কীভাবে যে কেটেছে আমার অন্তর্যামী জানেন। সামান্য একটু শব্দে মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে পাহাড় পড়ছে। সারা বাড়িটা যেন একটা নিঃশব্দ পৈশাচিক হাসির মূর্তি নিয়ে ঘিরে ধরছে দাঁত বসাবে বলে। ওই ভয়ংকরতার মাঝখানে থেকে থেকে খোকার কান্নাটা যেন একটা জান্তব চিৎকারের মতো লাগছিল।
খোকা তো কই কোনওদিন এমন কাঁদত না।
তবে কি ও সব কিছু বুঝে ফেলেছ? তবে কি ও ওর মাকে চিনত? এরপর ও ধরে ফেলবে আমি ওর মা নই, আমি ছদ্মবেশী! আমি পিশাচী, আমি ওর মার হত্যাকারিণী?
এমনি একটা অস্বাভাবিক চিন্তায় ক্রমশই আমার সব শক্তি হারিয়ে ফেলছিলাম, তারপর যখন রাত বেড়ে উঠল, খোকা ঘুমিয়ে পড়ল, তখন হঠাৎ মনে হতে থাকল এ ঘুম থেকে আর উঠবে না খোকা। খোকা আমাদের উপর ঘৃণায় ধিক্কারে ওর মার কাছে চলে গেছে। খোকা মরে গেছে।
মৃত সন্তানের শিয়রে একা বসে থাকা মায়ের মতোই অসহ্য যন্ত্রণার আবেগে কাঁপতে থাকলাম আমি, আর সেই সময় প্রিয়মাধব এল।
আমি ধৈর্য হারালাম, জ্ঞান হারালাম, এতদিনের সযত্ন লালিত মান মর্যাদা সব হারালাম, ছুটে গিয়ে ওর গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। দু হাতে ওকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলে উঠলাম, কেন? কেন? কেন তুমি আমায় ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ, ঠিক সেই মুহূর্তে আবিষ্কার করলাম আমার এতক্ষণকার বহুবিধ যন্ত্রণার জনক ছিল ওই ভয়। আমার সুপ্ত চেতনার মধ্যে ওই ভয় কাজ করছিল। সেই ভয়ে দিশেহারা হচ্ছিলাম আমি।
আমার এই দুর্বলতার সুযোগ ও ছাড়ল না।
অথবা ও সাংঘাতিক রকমের দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তাই ও আমাকে যেন দুহাতের মধ্যে পিষে ফেলতে চাইল। যেন মনে হল ওর সমস্ত দেহমন এই আবেগের আছড়ানির জন্যে তৃষিত হয়ে ছিল।
সুমিতা ওকে ভালবাসা দিয়েছে, আবেগের স্বাদ দেয়নি।
কিন্তু সেদিন আমাকে ঈশ্বর রক্ষা করলেন।
সেদিন ও রাত অবধি সাহেবদের ক্লাবে বসে মদ খেয়ে এসেছিল।
ওর সেই মদ খাওয়া আমার কাছে সেদিন বিরাট একটা শুভগ্রহ হয়ে দেখা দিল। নইলে–
হ্যাঁ,নইলে কে বলতে পারে কী ঘটতে পারত সেদিন। হয়তো অনিবার্যই ছিল সেই ঘটনা, আর সেই অনিবার্যতার পথ ধরে আমাদের এই অস্বাভাবিক জীবনের ইতিহাসই যেত পালটে। জানি না সেই পালটানোটাই শুভ ছিল কিনা। হয়তো তা হলেই সহজ আর স্বাভাবিক হতে পারতাম আমরা। পৃথিবীর আরও অনেক হাজার হাজার মানুষের মতো সাধারণ আর স্বাভাবিক।
কিন্তু তা হল না।
কারণ ও সেদিন মদ খেয়ে এসেছিল।
আর সেই উন্মাদ মুহূর্তের পরক্ষণেই আমার মনে হয়েছিল ওর এই মদ খাওয়াটা আমার পক্ষে বিরাট একটা শুভগ্রহ।
ওর বাহুবন্ধনের মধ্যে আটক পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওর মুখটা ঠেলে দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম আমি। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, তুমি মদ খেয়ে এসেছ?
সেই বোধহয় প্রথম তুমি বললাম।
আবেগে দুঃখে ধিক্কারে ঘৃণায় আর বোধ করি পরমুহূর্তেই ভয়ংকর একটা বিপদ থেকে মুক্ত হওয়ায়।
আমার সেই প্রশ্নটা কতখানি তীব্র হয়েছিল তা আমি জানি না। আমার মনে নেই, সেটা মানুষের স্বর হয়েছিল, না জানোয়ারের।