লোকটার ওই দাঁতের উপর একটা ঘুষি বসিয়ে সব কটা দাঁত ভেঙে দেবার ইচ্ছে সংবরণ করে চলে এসেছিলেন প্রিয়মাধব।
নমিতার যতদিন বিয়ে হয়নি, আর নমিতা যে কদিন সধবা ছিল, প্রিয়মাধব নিজেই এ-ঠাট্টা করতেন। হেসে হেসে বলতেন, তোমরা কদাচ দুজনে একরকম শাড়ি পোয়রা না বাপু! আমি হঠাৎ গুলিয়ে ফেলতে পারি। বলতেন, তোমাদের দুই বোনকে নিয়ে কোথাও যাওয়া আমার বিপদ, লোকে ভাববে ডাইনে-বাঁয়ে চিনির নৈবিদ্যি নিয়ে চলেছে লোকটা, বেড়ে ভাগ্যখানা তো!
কোথাও যাওয়া ব্যাপারটা সুমিতার সঙ্গেই হত নমিতার, কুমারী থাকতে, বিয়ে হয়েও। নমিতার উকিলবর বেজায় গম্ভীর গম্ভীর ছিল। তা ছাড়া এক ঘণ্টার দিদি হয়েও সুমিতা সত্যিই বড় বোনের মতো স্নেহময়ী ছিল। কোনও আমোদ-আহ্লাদ একা ভোগ করে সুখ পেত না।
সিনেমা-থিয়েটারে নিয়ে যাবে বলে নিজে গাড়ি ভাড়া করে গিয়ে নমিতার বরের অনুমতি আদায় করে নমিতাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসত। তখন প্রিয়মাধবের চা বাগানের চাকরিটা হয়নি। কলকাতাতেই কোথায় যেন কাজ করতেন।
অসম্ভব স্ফুর্তিবাজ, অসম্ভব প্রাণ-চঞ্চল, আর অসম্ভব শক্তিমান প্রিয়মাধব দুই বোনকে একসঙ্গে দুহাতে তুলে ফেলতে পারতেন কোমর ধরে।
নমিতা হাত পা ছুঁড়ে নেমে পড়ে বলত, দিদি না হয় আপনার বউ, ওকে বাঁদর-নাচ নাচাতে পারেন, আমায় কেন?
প্রিয়মাধব বলতেন, দিদি বউ, তুমি মউ! জানো না, ফাউয়ের তুল্য মিষ্ট বস্তু নেই? শালি হচ্ছে সেই ফাউ। তায় আবার যমজা।
কিন্তু নমিতা বিধবা হবার পর সেই চাপল্য সংবরণ করেছিলেন প্রিয়মাধব। দুই বোনের একরকম সাজের প্রশ্নও ওঠেনি। সেই বয়েসেই সব রং মুছেছিল নমিতা, সব বাহুল্য বর্জন করেছিল। চিরকালের বিধবার সাজে সেজেছিল।
সুমিতা কেঁদে ফেলে বলেছিল, হেমন্তকে তো তুই এত ভালবাসতিস না নমু যে, তার জন্য সর্বত্যাগিণী হবি। আমি তো জানি ওর প্রতি ভয় ছাড়া আর কিছু ছিল না তোর।
নমিতা হেসে বলেছিল, তার জন্যে সর্বত্যাগিণী হচ্ছি, এমন মিছে কথা তোমাকে কে ভাবতে বলেছে? ত্যাগ করেছি ধিক্কারে। সমাজ যদি ওই সবটা কেড়েই নিচ্ছে, তার থেকে সামান্য একটু হাতে রাখবার জন্যে আবার কাড়াকাড়ি করব কোন ঘেন্নায়? ভাল শাড়ি পরলে তো বলবে অনধিকার চর্চা!
তোর বয়েসে কে কবে কোথায় থান পরে? ওটা অসহ্য নমু!
নমিতা বলেছে, আমার আরও অসহ্য দিদি, থানের পাশে পাড়ের এক ফালি ক্যারিকেচার। সেটা আরও করুণ। আরও দৈন্যের।
হ্যাঁ, দিদিই বলত নমিতা তার একঘণ্টার বড় বোনকে। ছেলেবেলায় তাই শেখানো হয়েছিল ওকে। পিসি বলেছিল, তা হোক, একটুও ছোট বড় তো। ওতেই সম্পর্ক ঠিক করতে হয়।
মা ছিল না। শৈশবের যা-কিছু শিক্ষাদীক্ষা সবই পিসির কাছে।
কিন্তু শিক্ষাদীক্ষা কথাটার কি সত্যিই কোনও অর্থ আছে? দুটো সম্পূর্ণ একই বয়েসের মেয়েকে, একই পরিবেশে, একই শিক্ষায় শিক্ষিত করে, একই রকম কি গড়তে পেরেছিল পিসি?
পারেনি।
সুমিতার আর নমিতার আকৃতি এক ছিল। প্রকৃতি এক ছিল না। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতি নিয়ে গড়ে উঠেছিল নমিতা, সুমিতার সঙ্গে এক থালায় খেয়ে, এক বিছানায় শুয়ে।
সুমিতা ছিল প্রত্যেকটি বিষয়ে অপটু, নমিতা সব বিষয়ে পটু।
সুমিতা মৃদু, নমিতা প্রখরা।
সুমিতা অবোধ, নমিতা তীক্ষ্ণবুদ্ধি। সুমিতা স্নেহময়ী, নমিতার শরীরে মায়ামমতার বাহুল্য নেই।
এক ঘণ্টার বড় হয়েও সুমিতা বড়দিদি, এক ঘণ্টার ছোট হয়েও নমিতা ছোট বোন।
সুমিতা শান্ত স্তিমিত, নমিতা উজ্জ্বল অস্থির। নমিতার দেওর তাই বলেছিল, নিয়ে যান না, আমরা তো তা হলে বাঁচি।
.
বিধবা হয়ে নমিতা অনেক শান্ত হয়ে গিয়েছিল। তবু ওর শাশুড়ি ওকে দেখতে দেখতে রাতদিন অশান্তিতে জ্বলেপুড়ে মরত।
বলত, এই আগুনের খারা চিরদিন বুকে বয়ে মরতে হবে আমাকে।
নমিতা শুনে হাসত। আর সুমিতা প্রিয়মাধবের কাছে চোখের জল ফেলত।
এই সময় হঠাৎ প্রিয়মাধবের চা বাগানের কাজটা হল। অভাবিত, অপ্রত্যাশিত। তবু ভাগ্যের এই দানকে সুমিতা প্রসন্নমনে নিতে পারেনি। বলেছিল, আমি অতদূরে চলে গেলে নমুকে ওরা বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে।
অবশেষে ওই প্রস্তাব। নমিতাকে নিয়ে যাবে সুমিতা।
ওরা রাজি হল।
নমিতার শাশুড়ি বলল, চোখের আড়ালে গিয়ে যা-খুশি করগে মা, আমার হাড়ে বাতাস লাগুক।
তা বোনকে কাছে নিয়ে গিয়ে সুমিতারও হাড়ে বাতাস লাগল। সর্বদা নমু নমু করার দুর্ভাবনাটা গেল। স্নেহের বস্তুকে একান্ত কাছে রেখে ঠাণ্ডা হল। তা ছাড়া, ওই জনবিরল চা বাগানে বাঙালি বলতে অনেক দূরের মধ্যে কেউ ছিল না। প্রিয়মাধব তো নতুন দায়িত্বের কাজে মশগুল। কথা বলতে নমিতা, সঙ্গী বলতে নমিতা। কদাচ কখনও দূর থেকে কোনও বাঙালি পরিবার বেড়াতে আসত। বলত, খুব ভাগ্যে বোনটি পেয়েছেন বাবা! সঙ্গী তো বটেই, তা ছাড়া উনিই তো দেখছি সংসার মাথায় করে রেখেছেন।
নমিতার বৈধব্যটাকে সুমিতার ভাগ্য হিসেবেই গণ্য করত ওরা। বলবার সময় সেটা সামলাতে মনে থাকত না। সুমিতা অপ্রতিভ হত, সুমিতা অন্য কথা পাড়ত।
তারা চলে গিয়ে আড়ালে বলত, বোনের প্রতি ভাবটা দেখেছ? ঠিক ঝিয়ের মতো। ওকে একটু ভাল বলাটাও সহ্য হয় না। যমজ বোন, তাকে কী সাজিয়ে রেখেছে দেখো? হলই বা বিধবা, এখানে আর কে অত দেখতে আসছে?