সুমিতাকে আহা বলতে পারার সুযোগ পেয়েই কি করুণাময়ী হয়ে উঠেছিল নমিতা?
সুমিতা ওই আহা শুনে ওই করুণাবতীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিল।
সে দৃষ্টিতে নমিতা কেঁপে উঠেছিল।
নমিতা যেন পায়ের তলার মাটি খুঁজে পায়নি।
নমিতা সেদিন সে দৃষ্টির মানে বুঝতে পারেনি, কোনওদিনই বুঝতে পারেনি। এই সুদীর্ঘকাল পরেও কোনওদিন বুঝতে পারল না নমিতা, কী ছিল সেই চোখে?
রাগ? ঘৃণা? করুণা? হতাশা? মানুষের অপরিসীম নির্লজ্জতায় বিস্ময়? না শুধুই শূন্যতা?
সেই চোখকে নমিতার সমস্ত জীবনের উপর পুঁতে রেখে দিয়ে আস্তে উঠে গিয়েছিল সুমিতা ছেলের ঘর থেকে। পরদিন আর ছেলের ঘরে আসেনি!
পরদিন প্রিয়মাধবই ছেলে কোলে করে সুমিতার কাছে এল, অবাক হয়ে বলল, তুমি এই লবিতে পড়ে ছিলে বাকি রাতটা?তারপর বলল, দেখো আজ খোকা একেবারে সুন্দর সুস্থ। জ্বর ছেড়ে গেছে, মুখচোখের চেহারা বদলে গেছে। হাসছে খেলছে। এই নাও, একটু কোলে করো।
সুমিতা ক্লান্ত গলায় বলল, থাক। শরীরটা খারাপ লাগছে।
সুমিতার শরীর খারাপ লাগছে।
ছেলের সোহাগ মাথায় উঠল প্রিয়মাধবের। তাড়াতাড়ি ছেলেকে নমিতার কাছে দিয়ে এসে কাছে বসে পড়ল, ব্যস্ত হল। বারবার বলতে লাগল, দেখছ তো? বুঝতে পারছ শরীরের অবস্থা? বুঝতে পারছ কেন আমরা অত ব্যস্ত হই? কাল সেই যে রাত বারোটা অবধি জেগে ছিলে, তাতেই এইটি ঘটেছে।
তাই দেখছি। বলল সুমিতা, ক্লান্ত চোখ বুজে।
প্রিয়মাধব বলল, এই যদি সারারাত বসে জাগতে, কী হত বলো তো? খোকাটা হয়ে পর্যন্ত শরীরটা যে গেছে! তোমার ক্ষমতা থাকলে কেন তোমাকে আমরা
সুযোগ পেয়ে নিজের নিষ্ঠুরতার কৈফিয়ত দিয়ে নিয়েছিল প্রিয়মাধব। সুমিতা সায় দিয়েছিল।
সুমিতা বলেছিল, হ্যাঁ, বুঝতে পারিনি ক্ষমতা কত কম।
.
দুদিন উঠতে পারল না সুমিতা।
অর্ধেক রাত জেগেই এমন কাবু হয়ে পড়ল! শুধু চুপ করে শুয়ে রইল।
আর এমনি ভাগ্যের খেলা, ঠিক তখনই হঠাৎ ছুটি ক্যানসেল হয়ে বদলির অর্ডার এল প্রিয়মাধবের।
পঁচিশ মাইল দূরের একটা বাগানে কুলিরা খেপেছে, বুদ্ধিমান প্রিয়মাধবকে সেখানে দরকার। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চলে যেতে হবে।
দেখো কাণ্ড!
মাথায় হাত দিয়ে পড়ল প্রিয়মাধব। একেই খোকার ওই শরীর, এদিকে তোমার শরীর খারাপ, এখন এই অর্ডার!
সুমিতা বলল, তা কী করবে? চাকরি।
চাকরি তো বুঝলাম, কিন্তু এই কঘণ্টার মধ্যে সব গুছিয়ে নেওয়া
নমিতা আছে, সব ঠিক হয়ে যাবে।
প্রিয়মাধব বলল, তা যেন হবে, কিন্তু তোমার এই অবস্থায় যাওয়া যাবে?
সেও ঠিক ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
যাই নমিতাকে বলিগে।বলল প্রিয়মাধব।
সুমিতা যেন অবাক হল।
সুমিতা বলল, এতক্ষণ বলনি ওকে?
হ্যাঁ বলেছি। অর্ডারের কথা বলেছি। গুছিয়ে-টুছিয়ে নিতে বলিগে।
ব্যস্ত হয়ে চলে গেল প্রিয়মাধব।
নমিতাকে বলতে গেল কাজের কথা।
কিন্তু নমিতা কেন সুমিতার ঘরে আসেনি? সুমিতা দুদিন বিছানায় পড়ে আছে, তবুও না। ও কি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল?
ওর সর্বাঙ্গে যে দৃষ্টির দাহ, সেই দৃষ্টির ভয়ই কি করছিল আবার?
না কি ও শুধু ব্যস্ত ছিল?
আজ খানিক পরে ও এল।
খুব ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল, একেই তো তুই অসুখ বাধিয়ে বসে আছিস দিদি, খোকারও শরীর খারাপ! হঠাৎ এ কী হাঙ্গামা! ক ঘণ্টার মধ্যে সব গুছিয়ে নেওয়া। নে, গণেশ-জননী হয়ে বসে থাক। ধর। আমি রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ি গে।
সুমিতা হাত বাড়িয়ে ছেলেকে নিল না।
সুমিতা বলল, সামলাতে পারব না, শরীরে বল নেই।
নমিতা এ আশা করেনি। নমিতা থতমত খেল।
অপ্রতিভ গলায় বলল, একটু দেখতে পারবি না? খানিকটা গুছিয়ে নিতাম।
সুমিতা বলল, আয়ার কাছে দে গে।
সুমিতা ক্লান্তিবোধ করছিল, তাই চোখ বুজল।
সুমিতার রোগা হয়ে যাওয়া বুকের উপর পাতলা শাড়িটা নিশ্বাসের ভারে কাঁপতে লাগল।
নমিতা অপ্রতিভ হয়েছিল।
নমিতার বুকটা কাঁপছিল। তবু নমিতা আগের পার্ট প্লে করে বলল, বাঃ, তোর ছেলে তোর সংসার, তুই একটু সামলাবি না?
তারপর নমিতা আবার কেঁপে উঠল। আপাদমস্তক বিদ্যুতের শক খেল।
নমিতা প্রায় ছুটে পালিয়ে গেল।
নমিতাকে তাড়া করতে আসছে সেই চোখ! সেই সে রাত্রের চোখ।
নমিতা যতদিন বেঁচে ছিল, সেই চোখ তাকে অবিরাম তাড়া করেছে। নমিতার দিনের শান্তি রাতের ঘুম, সব হরণ করেছে সেই চোখ। সুমিতার সেই চোখ। কোনও দিনই যার ঠিক মানে বুঝতে পারেনি নমিতা।
.
কিন্তু নমিতা আর কদিন বেঁচে ছিল? যেদিন বদলি হল প্রিয়মাধব, সেইদিনই না নমিতার দেওরদের টেলিগ্রাম করতে হল তাকে। নমিতা মারা গেছে। হঠাৎ বিষ পোকার কামড়ে
হ্যাঁ সেই তারিখ। প্রিয়মাধবের বদলির আর নমিতার মৃত্যুর তারিখ একই।
সুমিতা চাঙ্গা হয়ে উঠল। ছেলে কোলে নিয়ে সুমিতা তার বরের সঙ্গে নতুন চা বাগানে চলে গেল, নমিতা মারা গেল।
অথচ নমিতার ওই রাতারাতি মারা যাবার কথাটা বাংলোয় বলতে সাহস করেনি প্রিয়মাধব। বিদায় বেলায় যখন বকশিশের আশায় একধার থেকে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল চাকরানি, গয়লানি, ধোপানি, জমাদারনির দল, ওরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল, মাসি মেমসাহেব কোথায়?
প্রিয়মাধব বলেছিল, ও হঠাৎ শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। শাশুড়ির অসুখের খবর পেয়ে।
চলে গেছে! ওরা হাঁ করে তাকাল।
কেউ দেখল না। চলে গেল।
কে আর দেখবে? রাত্রের প্লেনে চলে গেছে। হ্যাঁ, উড়োজাহাজে চড়ে উড়ে চলে গেছে মাসি মেমসাহেব।