তারপর সেই একচক্ষু হরিণের গল্পের হরিণের মতো অবস্থা ঘটল প্রিয়মাধবের।
এল সেই ভয়ংকর দিন।
.
খোকার অন্নপ্রাশনের কথা উঠল।
আট মাস বয়েস হয়ে গেল খোকার, আর দেরি করা চলে না।
প্রিয়মাধব বলল, এই ছুতোয় কটা দিন ছুটি নিয়ে কলকাতায় যাওয়া যাক।
আর এই প্রস্তাবে হঠাৎ যেন সুমিতার হৃদয়-নদীতে বান ডাকল।
সুমিতা সেই অনেকদিন আগের মতো উল্লাসে আর উদ্ভাবনীশক্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
ও জামাপত্র গোছাতে গোছাতে বলে, হ্যাঁ গো, খোকনের খাটটা নিয়ে যাওয়া হবে? দোলা খাটটা?
প্রিয়মাধব অবাক হয়ে বলল, খাটটা? খাটটা নিয়ে যাওয়া হবে?
বাঃ খোকা দোল খাবে না? অপ্রতিভ হাসি হাসে সুমিতা।
খোকা মা-মাসির কোলে দোল খাবে বলেই হাঁক পেড়েছে প্রিয়মাধব, এই নমিতা শুনছ, তোমার দিদি খোকার দোল খাবার জন্যে দোলনা খাটটা নিয়ে যেতে চাইছে।
নমিতা বলে উঠেছে, বেশ করেছে চেয়েছে। কেন চাইবে না? কোম্পানি তো মালের দাম দেবে।
কোম্পানি দেবে?
হা হা করে হেসে উঠেছে প্রিয়মাধব।
কেন, কোম্পানি দেবে কেন? এ কি আমি ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছি? বেড়াতে যাব ছেলের মুখে ভাত দিতে, কোম্পানি নেবে তার ভার? ছুটি দিচ্ছে এই ঢের!
তা বটে। সেই ঢের।
চা-বাগানের কাজে ছুটিটা বড় দুর্লভ।
সেই দুর্লভ বস্তু সংগ্রহ করে ফেলেছিল প্রিয়মাধব কলকাতায় গিয়ে ছেলের অন্নপ্রাশন দেবে বলে। কিন্তু সেই দুর্লভ বস্তু কি ভোগ হয়েছিল প্রিয়মাধবের? হয়নি।
ছেলের গয়না ও চেলির ফর্দ লেখা প্রস্তুত, ছেলের ভাতের যজ্ঞির ফর্দ প্রস্তুত, কাকে কাকে নেমন্তন্ন করা হবে তার ফর্দ প্রস্তুত, শুধু রাত পোহালেই রওনা।
হঠাৎ রাত্রে ছেলের গায়ে হাত দিয়ে শিউরে উঠল সুমিত্রা!
জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
.
আচ্ছা, সুমিতার কাছেই কি শুত খোকন?
না, শুত না।
তিনমাস বয়েস থেকেই নমিতা ওকে নিজের কাছে নিয়ে শুতে আরম্ভ করেছিল। শুধু তখন কয়েকটা দিন শুচ্ছিল খোকা সুমিতার কাছে–সেই যে নমিতার কদিন আগে সর্দিজ্বর হয়েছিল, সেদিন থেকে নমিতা নিজেই এ ব্যবস্থা করেছিল। বলেছিল, সর্দি জিনিসটা বড় ছোঁয়াচে, বিশেষ করে বাচ্চাদের খুব তাড়াতাড়ি আক্রমণ করে।সুমিতা নিশ্চয়ই নমিতার ওই সামান্য অসুস্থতাটাকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে মনে করেছিল। খোকাকে কাছে নিয়ে শুতে পাওয়া সুমিতার কাছে তো কম পাওয়া নয়।
প্রথম সকালে নমিতা বলেছিল, কী রে, রাতে ঘুমিয়েছিলি তো? না কি সারারাত অপলক নেত্রে বৎসমুখপানে তাকিয়ে বসে রাত কাবার করেছিলি?
সুমিতা বলেছিল, কেন? আমি কি পাগল?
নমিতা হেসে দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, তা পাগল ছাড়া আবার কী? জানিসই তো আপনার ধন পরকে দিয়ে, পাগলা বেড়ায় মাথায় হাত দিয়ে! তুই তো প্রায় তাই!
সুমিতা বলেছিল, পর আবার কে আছে বাপু আমার? এক আছে বর, আর আছিস তুই, নিজেরই অর্ধাংশ। ওই অর্ধাংশ শব্দটার উপর কি একটু বেশি জোর দিয়েছিল সুমিতা? তাই নমিতা চমকে উঠেছিল। ভেবেছিল নমিতাকে তাদের দুজনের মধ্যেকার সম্পর্কের নিবিড়তা বুঝিয়ে দেবার জন্যেই, সুমিতার এই জোর নাকি?
চমকে ওঠা নমিতা নিজেকে সামলে নিয়ে হঠাৎ খুব হেসে উঠেছিল। দিদিকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, উঃ, তুই যে আজকাল বেজায় কথা শিখেছিস দেখছি। বরের সঙ্গগুণে, কেমন?
সুমিতা হেসে বলেছিল, কেন, বরের সঙ্গগুণে কেন? তোর সঙ্গগুণটা কিছু নয় নাকি?
আমার সঙ্গ তো মাতৃগর্ভের সূচনা থেকেই। সে গুণ ধরেছিল কই? চিরদিনই তো তোতে আর আমাতে আকাশ-পাতাল তফাত।
সুমিতা আবার হেসেছিল, তফাতটাই তো আসল মিল। যেমন মেয়ে আর পুরুষ।
সুমিতা প্রায় সব সময়ই হাসত। মনে হত হেসে কথা কওয়াই তার স্বভাব ছিল। কিন্তু সেটা যে সত্যি স্বভাব নয়, সেই হাসিটাকে যে ওকে বুক ছিঁড়ে বার করতে হত, এ কথা যখন স্পষ্ট বোঝা গেল, তখন ওর সেই হাসি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শুধু আসামের চা বাগানের ম্যানেজারের কোয়ার্টার্সেই নয়, পৃথিবীর কোথাও রইল না সেই হাসি।
.
কিন্তু সেদিন হাসেনি সুমিতা।
যেদিন রাত্রে খোকার গায়ে হাত দিয়ে দেখেছিল খোকার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সেদিন ডুকরে কেঁদে উঠেছিল, ওগো, খোকা কীরকম করছে বলে।
আচমকা এই প্রবল জ্বরে, তড়কা হল খোকার। সুমিতা কেঁদে উঠল। উদ্ভ্রান্ত হয়ে ডাক্তার আনাল প্রিয়মাধব। ডাক্তার বলে গেল সারারাত ওয়াচ করতে। বলে গেল, ওষুধটা দেবেন যদি বাড়ে।
সারা বাড়িতে একটা তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল। আয়া চাকর সবাই উঠেপড়ে ছুটোছুটি করছিল। নমিতা ও ঘর থেকে উঠে এসে ছেলের কাছে বসে ছিল। জলপটি আর বাতাস চলল।
জ্বর কমলে প্রিয়মাধব বলল, সুমিতা, তুমি বরং একটু ও ঘরেই না হয় শুতে যাও।
সুমিতা বলল, না, আমি এখানেই থাকি।
প্রিয়মাধব নমিতার সামনেই ওকে পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, লক্ষ্মীটি, তোমার শরীর ভাল নয়, রাত জেগে তুমি আবার একটা অসুখ বাধিয়ে বসবে–
সুমিতা কখনও জেদ করে না, সেদিন করল।
বলল, না, কিচ্ছু বাধাব না কথা দিচ্ছি। আমার শরীর খুব ভাল আছে। আমার চলে যেতে ভয় করছে।
তবু প্রিয়মাধব তাকে নিবৃত্ত করল। বলল, ভয় নেই, ভয়ের কিছু নেই। তড়কা তো বাচ্চাদের হয়েই থাকে।
নমিতা কিন্তু সেদিন নিষ্ঠুরতা করেনি। বলেছিল, আহা, থাক না হয় জামাইবাবু! যতই হোক মায়ের প্রাণ!