ছেলেকে কোলে করবার জন্যে এত আকুলতা দেখাত মাঝে মাঝে, কিন্তু ওই হুড়োহুড়ি খেলার মধ্যে কিছুতেই ভূমিকা নিতে চাইত না সুমিতা।
সুমিতা কেবল নিভৃতে একান্ত করে পেতে চায় তার ছেলেকে।
সুমিতা লোকলোচনের অন্তরালে তার মাতৃস্নেহ উজাড় করে দিতে চায় মাতৃসুধাঁধারার মাধ্যমে। যেটা নাকি প্রিয়মাধব আর নমিতা দুজনের কাছেই বিশ্রি রকমের গাঁইয়া ঠেকে।
সেই ঠেকাটাকে অবশ্য ওরা চাপতেও চেষ্টা করে না।
যদি হঠাৎ আবিষ্কৃত হয়ে পড়ে সুমিতা আয়ার কাছ থেকে লুকিয়ে ছেলেকে হাত করে ঘরে পুরেছে, প্রিয়মাধব হাঁ হাঁ করে ওঠে, আরে বেশ তো বাগানে বেড়াচ্ছিল, হঠাৎ আবার বন্ধ ঘরের মধ্যে পুরলে কেন? এদিকে তো এত বিদ্যে বুদ্ধি, এটার ব্যাপারে এমন বুদ্ধিভ্রংশ কেন?
সুমিতা ক্ষুব্ধকণ্ঠে জবাব দেয়, বুদ্ধিভ্রংশ ছাড়া বুঝি কেউ ছেলেকে কোলে নেয় না?
প্রিয়মাধব বলে, ওই অসময়ে কোলে নেওয়া, দুধ খাওয়ানো সবই গ্রাম্যতাদুষ্ট।
সুমিতা বলে, বেশ তো, মনে করো গ্রাম্যই। খোকার ঝি বলেই চালিও।
নমিতা অন্য সুর ধরত।
নমিতা ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলত, এই যে গণেশ-জননী! আহা এই দেবীরূপ চোখে দেখলেও পুণ্যি!
সুমিতা বলত, এক্ষুনি নামিয়ে দেব।
আহা নামিয়ে দিবি কেন, থাক না, থাক। শুধু হাতজোড় করছি দয়া করে এখন আর খাওয়াতে বসিস না।
সুমিত্রা অপ্রতিভ গলায় বলত, না না, খাওয়াব কেন?
কেন তা তুইই জানিস! নমিতা মুখ টিপে হেসে বলত, বোধহয় বক্ষভার লাঘব করতে! আমি কী করে বুঝব বল ওই পরমতম রহস্য?
সুমিতা উঠে গিয়ে ছেলেকে আয়ার কাছে দিয়ে আসত। হ্যাঁ, উঠে গিয়েই দিয়ে আসত, চেঁচিয়ে ডাকত না কখনও কোনও ঝি-চাকরকে।
৪. পড়ন্ত বিকেল
আবার কতদিন এমন হয়েছে বাগানে গেছে সবাই ছুটির সকালে কি পড়ন্ত বিকেলে। খোকার সঙ্গে সঙ্গে আয়া আছে এবং বাগানে খুশির ঝড় বইছে। হঠাৎ একসময় দেখা গেল সুমিতা নেই। সুমিতা কখন যেন উঠে গেছে, ভিতরে চলে গেছে।
নমিতা অনেকক্ষণ লক্ষ না করার ভান করত, গাছপালাকে ঘিরে ছুটোছুটি করত, এবং নেহাত একসময় না বললে নয় বলেই বলে উঠত, ওমা দিদিটা কখন পালাল! বাবাঃ একটু যদি বসতে পারে। নির্ঘাত ওর উলের গোলা ওকে টানছিল।
প্রিয়মাধব বলত, আচ্ছা এই উলবোনাটা তো ছিল না তোমার দিদির!
নমিতা বলত, না মোটেই না। খাসিয়া মেয়েগুলোর দেখে দেখে শখ লেগেছে। এখানে দুধওয়ালি সবজিওয়ালিগুলো পর্যন্ত কী ফার্স্টক্লাস বোনে দেখেছেন তো?
প্রিয়মাধব বলত, তা কই, বুনছেন কী? সেটা তো দেখি না।নমিতা হেসে ফেলত।
সত্যি সেটা দেখা যেত না বটে। খোকার একটা পুলওভার ধরেছে এইটুকু দেখা যায়, ছাড়তে দেখা যায় না।
অথচ–বোধ করি টেক্কা দেবার মনোবাসনা নিয়েই নমিতা কেবলমাত্র রাত্রে ঘুমের সময় বুনে বুনে খোকার এবং খোকার বাবার দু দুটো সোয়েটার বানিয়ে ফেলে চকিত করে দিয়েছিল দুজনকে। তবে বলল না রাত্রে বুনেছি। ওরা অবাক হল। সুমিত্রা, আর তার বর। অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, বুনলে কখন?
নমিতা অবহেলায় বলল, এই কাজের ফাঁকে ফাঁকে এক আধ সময়।
উল কিনে দিল কে?
ওমা সেটা আবার একটা চিন্তার কথা নাকি। কিনিয়েছি দাইকে দিয়ে।
খোকার গায়ে সেই সোয়েটারই শোভা পেতে লাগল, তার মায়ের হাতের পুলওভারটা অসমাপ্তই পড়ে রইল ড্রয়ারের এক কোণে।
প্রিয়মাধবও সহর্ষে শালির অবদান অঙ্গে জড়িয়ে বেড়াতে লাগল।
তারপর থেকেই সুমিতা যেন আবার গল্পের বইয়ে বেশি মজল।
প্রিয়মাধব বলত, এটা আবার তোমার কী হল? এত বই বই বাতিক তো ছিল না কখনও? এখানে এই পাণ্ডববর্জিত দেশে এত বাংলা বই কোথায় পাই?
দিদি আর কিছু বলত না, চিঠি লিখে টাকা পাঠিয়ে কতকগুলো পত্র পত্রিকার গ্রাহিকা হয়ে পড়ল।
প্রিয়মাধব বলত, একেই বলে রক্তধারা। মনে হচ্ছে তোমাদের বাবার বাতিক আস্তে আস্তে এসে ধরবে তোমাদের।
.
আড়ালে দিদি আর প্রিয়মাধব কোন কথা বলত তা আমি জানি না, কিন্তু দিদির হাসিটা তো ঠিকই বজায় ছিল। যেটা আমাকে অবাক করত। দিদি যদি সর্বদা বিষণ্ণ থাকত, একটা যেন মানে পেতাম। তা থাকত না সে।
হয়তো কোনওদিন আমাদের কলহাস্যের মাঝখান থেকে উঠে গেছে দিদি, প্রিয়মাধব একটু পরে কাছে গিয়ে বলত, কী হল? তুমি কি কুপিতা হয়ে চলে এলে?
দিদি অবাক হয়ে যেত যেন।
বলত, কেন? একথা বলছ কেন হঠাৎ?
যে রকম নিঃশব্দে উঠে এলে সভা থেকে!
দিদি হেসে ফেলত।
সাজানো দাঁতের পাটি ঝকঝকিয়ে উঠত। যেটা হয়তো আমারও হয়, তবে নিজে দেখতে পাই না এই যা।
দিদি হেসে ফেলে বলত, তা উঠে আসাটা সশব্দ করতে হবে নাকি? সেটা কেমন, জানা তো নেই।
ওই হাসিটাই ওর ছদ্মবেশ ছিল।
পরে বুঝতে পেরেছি, ওকে যখন আমরা বোকা, বেচারি, অবোধ ভেবে করুণা করেছি, ও তখন ওর এই ছদ্মবেশটি এঁটে আমাদের বোকা বুঝিয়েছে, আমাদের ঠকিয়েছে।
হ্যাঁ, ঠকিয়েছে।
প্রিয়মাধব আর নমিতা ধরতে পারত না।
খোকার অসুখ করলে সুমিতাকে ঘুমোতে পাঠিয়ে রাত জেগে খাড়া বসে থাকত নমিতা আর প্রিয়মাধব। খোকাকে দেখতে এসে ডাক্তার যদি সুমিতাকে কোনও প্রশ্ন করত, প্রিয়মাধব বলত, তুমি কি ঠিক বলতে পারবে? নমিতা এসে বুঝিয়ে বলুক।
এতে সুমিতা আহত হতে পারে, অপমানিত হতে পারে, এ কথা মাথায় আসত না প্রিয়মাধবের। সুমিতা সম্পর্কে চিরনিশ্চিন্ত ছিল সে।