তা বলে আমি শিখব না?
শিখিস। আরও দু-চারটে হোক, তখন শিখিস। এটার উপর দিয়ে আর হাত পাকাতে চাসনি।
বলে সেই চাঁদের টুকরো আর পাথরের কুচির মতো ছেলেটাকে নাচিয়ে নাচিয়ে স্নান করাতাম আমি।
দিদি ঘরে চলে যেত।
গল্পের বই নিয়ে শুয়ে পড়ত।
এতকাল গল্পের বইয়ে ঝোঁক দেখিনি দিদির। ইদানীং সে ঝোঁক দেখছি।
.
এটা কি আমার বড় বেশি নিষ্ঠুরতা হত?
সুযোগ পেয়ে আমি আমার আজন্মের জ্বালার শোধ নিতাম কি এই অভিনব উপায়ে?
হয়তো তা নয়।
এই দুরকালের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে সেই থানপরা নমিতাকে দেখতে পাচ্ছি আমি, শুধু নিষ্ঠুরতার উল্লাসেই নয়, অনেকটা লোভের বশেও এই নিষ্ঠুরতা করেছে সে। তার বুভুক্ষু চিত্ত একটা শিশুর অধিকার পেয়ে তার তিলার্ধ ছাড়তে রাজি হত না। সবটা দখল করে থাকতে চাইত। কেবলমাত্র মাতৃদুগ্ধের জোগানে হেরে যেতে হচ্ছে দেখে, ছেলেটাকে অবিরত বাইরের খাদ্যে ভরিয়ে রাখত। সুমিতা যখন তার মাপা এক-আধবারের ভূমিকা নিয়ে বুকের দুধ খাওয়াতে যেত, শিশু স্বভাবতই মুখ ফেরাত, আর নমিতা যেন বিজয়িনীর উল্লাস অনুভব করত।
অথচ সভ্য মার্জিতবুদ্ধি সুমিতা আপন সন্তানকে নিয়ে কাড়াকাড়ির কথা ভাবতে পারত না।
নমিতার কি সুমিতার ওই বঞ্চিত মুখের দিকে তাকিয়ে একবারও মমতা আসত না?
মনে কি হত না, আহা নিক ও ওর ছেলেকে!
হত
কিন্তু এও যে জানত সে, মা যতই অপটু হোক, ছেলে তার হাতে পড়লে ঠিকই চালিয়ে নেবে, আর ঠিকই মায়ে-ছেলেয় আপস হয়ে যাবে।
অতএব আবার নমিতার ভাগ্যে সেই মুষ্টি ভিক্ষা!
.
তা ছাড়া প্রিয়মাধব।
প্রিয়মাধব তো ধারণা করে নিয়েছে, সুমিতা অচল! সুমিতার হাতে পড়লে খোকা বেশিদিন নয়। নমিতা না থাকলে খোকাকে বাঁচানো যেত না। প্রিয়মাধবের ওই ধারণাটা তো আলগা হয়ে যাবে। প্রিয়মাধব ত বুঝে ফেলবে সুমিতার ছেলেকে সুমিতা ঠিকই সামলাতে পারে।
এই জেনে ফেলতে দেওয়া যে নমিতার পরম লোকসান। নমিতা শুধু আদরের পুতুল হয়ে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল, শুধু করুণার পাত্রী হয়ে থাকতে অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। সংসার পরিচালনার ভূমিকাটা ধর্তব্য করছিল না নমিতা, সেটা তো মাইনে করা লোকও পারে। খোকার সূত্রে নমিতা দরকারি হয়ে উঠেছে। অবশ্য-প্রয়োজনীয়ের পরম ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছে। অতএব মার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাক খোকা, যাতে মার থেকে মাসিকেই বেশি ভজে সে।
আর সেই ভজনার সূত্রে তার বাবাও সেই মাসিকে ভজতে থাকুক মন-প্রাণ দিয়ে।
তা সেটা হত বইকী!
প্রায়ই তার প্রমাণ পাওয়া যেত।
যেমন খোকা রয়েছে মাসির কোলে, প্রিয়মাধব দুহাত বাড়িয়ে ডাকত, আয়, আমার কাছে আয়। দুষ্টু মাসিটার কাছে থাকবি না। সঙ্গদোষে উচ্ছন্ন যাবি। বাবার বোলচালে মুগ্ধ খোকা দু হাত বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে এসে পড়ত বাবার বুকে।
নমিতা বলত, নেমকহারাম ভূত! দেখব কে তোকে আর কোলে নেয়।
ততক্ষণে কিন্তু খোকা আবার মাসির দিকে দু বাহু প্রসারিত করে বাবার কোল থেকে ঝুলে পড়েছে।
পঞ্চাশবার এই একই খেলার পুনরাবৃত্তি হয়েছে, আর প্রতিবারই একটি সপ্রেম কটাক্ষ, একটু মিঠে কড়া রসিকতা, একটু বা চকিত স্পর্শ লাভ হয়েছে নমিতার ভাগ্যে।
সময়ের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে নমিতা এবং খেলাটাকে যথেষ্ট পরিমাণে সরব সহাস্য করে তুলে নার্ভগুলোকে ঠিক রাখবার চেষ্টা করেছে। খোকা, খোকার বাবা, খোকার মাসি, তিনজনের মিলিত কলহাস্যে বাসাটা মুখর হয়ে উঠেছে।
খোকার মা কি এ সভায় থাকত না?
থাকত! কখনও থাকত কখনও থাকত না। তবে তার ভূমিকা তো সর্বদাই দর্শকের।
মুখটা হাসি হাসি করে হাতে একটা উলের গোলা আর দুটো বোনার কাঠি নিয়ে বসে থাকত হয়তো।
প্রিয়মাধব তাকে উদ্দেশ করে বলত, দেখো তোমার ছেলে কী সাংঘাতিক বেইমান। বাবাকে গ্রাহ্য মাত্র করছে না।
সুমিতা হেসে বলত, সে তো হবেই। ছেলেটা যে আবার তোমারও।
প্রিয়মাধব রাগের ভান দেখিয়ে বলে উঠত, তার মানে? এটা যেন আমার প্রতি কটাক্ষপাত মনে হচ্ছে।
কটাক্ষপাত নয়, আলোকপাত।বলে মৃদু হেসে মুখ নামিয়ে হাতের কাজে মন দিত দিদি।
মাঝে মাঝে নমিতা আবার ছেলেটাকে এগিয়ে নিয়ে দিদির কাছে দাঁড়িয়ে বলত, যা বুদ্ধ যা, মার কাছে যা। মার থেকে মাসির দরদ হাসির কথা, বুঝলি হাবা? যা!
বলা বাহুল্য ছেলেটা স্বভাবতই বসে থাকা মায়ের থেকে দাঁড়িয়ে থাকা মাসিকেই বেশি পছন্দ করত। অতএব মাসির গলাটা প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে মুখ ফিরিয়ে নিত।
নমিতা হেসে হেসে বলত, বটে বটে! বাবা তো তবে ঠিকই নামকরণ করেছে। বেইমান!
বোকা সুমিতা এসব রঙ্গরসে যোগ দেওয়ার থেকে অনেক বেশি দরকারি মনে করত পশমের প্যাটার্নটা নির্ভুল হচ্ছে কিনা লক্ষ রাখতে।
কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ এক সময় নমিতার মনে হত, দিদি প্যাটার্নফ্যাটার্ন কিছুতে খেয়াল রাখছে না, শুধু ঘর বুনে যাচ্ছে। আর দিদির মুখটা সেই অর্থহীন ঘরগুলোর দিকে আরও ঝুঁকে পড়ছে।
ওই মুখটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ একসময় হয়তো নমিতার এই কলরব কলহাস্য নেহাত খেলোমি মনে হত। আর রাগ এসে যেত নিজের উপর।
বলত, হয়েছে, খুব নাচানো হয়েছে। কাজ নেই যেন আর! নে দিদি তোর ছেলে ধর! অনেক কাজ পড়ে আছে আমার
ছেলেটাকে ফেলে দিতে আসত সুমিতার কোলে। কিন্তু সুমিতার হাতে যে দুদুটো উঁচলো কাঁটা। সুমিতা তাই, আরে আরে কাঁটা কাঁটাবলে শিউরে দাঁড়িয়ে পড়ত। তারপর কাঁটা-পশম গুছিয়ে নিতে নিতে বলত, ছেলেধরা তো সামনেই রয়েছে। ওকে দে না।