এ সন্দেহ প্রবল হলেই আমি সোজা বলে দিতাম, আমার বয়ে গেছে। তোর বরের যত্ন তুই করগে যা।
দিদি হেসে হেসে বলত, সাহেব, শুনছ তোমার শালি কী বলছে?
সাহেব বলত, ঠিক শালিজনোচিত কথাই বলছে।
এখানে আসার পর থেকে ঠাট্টা করে আমি যেমন ম্যানেজার সাহেব বলতাম, দিদিও তেমনি ওগো হ্যাঁগো ছেড়ে সাহেবটাই রপ্ত করে ফেলেছিল। এও একটা লীলা।
আমি, দিদি আর প্রিয়মাধব।
এই তিনটি মুখ সংসারে।
তা ছাড়া চাকরানি, গোয়ালিনি, জমাদারনি, ধোপানি। এখানে মেয়েরাই বেশি কাজ করে। এদের মুখ ছাড়া ভদ্রলোকের মুখ দুর্লভ।
তবু অন্য বাগানের থেকে কোনও কোনও বাঙালি পরিবার কদাচ বেড়াতে আসতেন। এবং যথারীতি দিদির গৃহে আমার এই উপস্থিতিকে দিদির পরম ভাগ্য বলে ঘোষণা করে, আমাকে আহা করে যেতেন।
সে রকম দিনে ওরা চলে গেলে দিদি বড় বেশি মনমরা হয়ে থাকত। বলত, এখন মনে হচ্ছে হয়তো আমার ভালবাসাটা ছল, হয়তো নিজের স্বার্থের জন্যেই তোকে এখানে টেনে এনেছি আমি। নিজের মন তো বোঝা যায় না। আমি অপারগ তুই পারগ, তাই হয়তো তোর উপর আমার লোভ হয়েছিল। তাই ই তো করছি আমি। সব ভার তোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজে আরাম খাচ্ছি।
দিদির সেই ক্ষুব্ধ ক্ষুণ্ণ মুখ দেখে মায়া হত বইকী! তখন হয়তো আমিই ওর মন ভাল করতে বেশি হইচই করতাম, ম্যানেজার সাহেব ম্যানেজার সাহেব করে হাঁক পেড়ে দিদির এই বৃথা দুঃখের বার্তা জানিয়ে হাসতাম। এবং যারা এসে দিদির মন খারাপ করে দিয়ে যাচ্ছে তাদের মুণ্ডপাত করতাম।
এই ভাবেই ঘুরে এল বছরখানেক। আসাম উপত্যকার প্রকৃতিতে ষড়ঋতুর খেলা দেখা হয়ে গেল।
আর এর মধ্যেই বিধাতার সেই চিরন্তন খেলার সূচনা দেখা দিল।
এটা যত অপ্রত্যাশিত, তত আনন্দের।
ম্যানেজার সাহেব আহ্লাদে দিশেহারা হলেন, দিদি বিগলিত হল।
এতদিন বিয়ে হয়েছে দিদির, ছেলেমেয়ে সম্পর্কে ওরা তো প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছিল।
সেই আশার আলোক দেখা দিয়েছে।
দিদির এই নতুন সৌভাগ্য ম্যানেজার সাহেবের বাংলোয় উচ্ছ্বাসের জোয়ার বহালো। সত্যি বলতে, আমি যেন দিদির এই নতুন ঘটনায় নির্মল হয়ে গেলাম, পবিত্র হয়ে গেলাম। দিদির এই মাতৃত্বের সূচনা ওকে এমন অসহায় অসহায় আর ছেলেমানুষ ছেলেমানুষ মতো করে তুলল যে, ওর উপর থেকে চিরকালের সেই ঈর্ষাটা সরে গেল আমার, মমতায় মন ভরে উঠল। প্রিয়মাধব আর আমি দুজনে আমরা যেন একটা নাবালিকার অভিভাবক। ওই বালিকা নাবালিকাটি হঠাৎ একটা মস্ত সম্পত্তির অধিকারিণী হয়ে বসেছে, অথচ বেচারা কিছুই জানে না, কিছুই সামলাতে পারে না, এমনি একটা ভাব আমাদের। অতএব–উঠতে বসতে দিদিকে সাবধান করি আমরা, যখন তখন ডাক্তার আনা হয়। এ অবস্থায় কী করা উচিত আর না উচিত, তার একটা বিরাট তালিকা প্রস্তুত হয়।
সৌভাগ্যবতীর সৌভাগ্য নতুন করে ঝলসে ওঠে।
বিয়ের ছ বছর পরে
আসামের চা-বাগানে দিদির প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়।
.
আমি আর প্রিয়মাধব দিদির দুই অভিভাবক অনভিজ্ঞ দিদিকে দিদির ওই সদ্যোজাত শিশুটির মতোই উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে দেখতে থাকি, উদ্বিগ্নমনে তদ্বির করি ওর।
আর সেই সূত্রে যেন প্রিয়মাধব আর আমি অন্য এক ঘনিষ্ঠতার সূত্রে আবদ্ধ হয়ে যাই। আগে দিদি বড় ছিল, আমাকে নিতান্তই বালিকা হিসেবে দেখত দিদি। এখন পট পরিবর্তন হল, দিদি ছেলেমানুষ হয়ে গেল। এই পরিবর্তনটা তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করতাম আমি।
ছেলেকে দিদির কাছে দিতেই চাইতাম না আমরা।
দিদি যে কিছুই পারে না এটা যেন পাথরের গায়ে খোদাই করে লেখা হয়ে থাকা দরকার।
দিদি শুধু সেবার পাত্রী, আমি বাদবাকি সব। আমার ইচ্ছেয় সব।
দিদি নরম গদির বিছানায় বসে অপ্রতিভ অপ্রতিভ কুণ্ঠিত মুখে আবেদন করত, খোকাকে আমার কাছে দে না একটু?
আমি শাসনের সুরে বলতাম, উঁহু! এখন টাইম নয়। তোমার কাছে দিলেই তুমি এক্ষুনি বক্ষদুগ্ধ পান করাতে বসাবে, সেটা ক্ষতিকর।
দিদি বলত, দেব না সত্যি বলছি, দেখিস।
কাতরতায় গলতাম না আমি।
কারণ দেব না বলেও দিয়েছে লুকিয়ে লুকিয়ে, এ দৃষ্টান্ত আছে।
প্রিয়মাধবেরও প্রিয়ার স্বাস্থ্য এবং প্রিয়পুত্রের সর্ববিধ কল্যাণের চিন্তায় মনের চেহারা বদলে গিয়েছিল নমিতার। সুমিতার সব কিছুই ছেলেমানুষি বলে উড়িয়ে দেবার পরম সুখটার আস্বাদ তাকে নিষ্ঠুর করে তুলেছিল। সূচনা কালের সেই মমতাটা ক্রমশ ঝরে যাচ্ছিল, দিদির ওই আকুলতা আর আবেদনের যন্ত্রণা দেখে নিষ্ঠুর একটা আমোদ পেতাম আমি। অতএব ছেলেকে ঘড়ি ধরে আদর করতে পাওয়া ছাড়া আর পাবার হুকুম ছিল না সুমিতার!
সুমিতা যদি একদিন শখ করে ছেলেকে নাওয়াতে আসত, নমিতা বলত, ম্যানেজার সাহেব, ক্যামেরা আনুন! আর অনেক হাসির পর ছেলে এবং সরঞ্জাম কেড়ে নিয়ে বলত, রক্ষে কর দিদি, ঠিক তুই ওকে হাত ফসকে ফেলে দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিবি।
দিদি ছেড়ে দিত।
দিদি অপ্রতিভ হাসি হেসে বলত, বাঃ আমি যেন ওর মা নই?
মা তাতে কী? মহারানিরাও তো মা হয়, তারা কি ছেলে নাওয়াতে বসে?
আহারে, আমি যেন মহারানি?
ওরে বাবা, তা আবার বলতে? মহারানির ছেলেরা ধাইমার কাছেই মানুষ হয়।
দিদি এক একসময় কুণ্ঠিত গলায় বলত, তা একেবারেই শিখব না? ধর একদিন তোর শরীর খারাপই হল
নার্স আনবেন ম্যানেজার সাহেব।