এই ভঙ্গি কি ভিতরের পূর্ণতার রূপ?
ওর সবটা ভরাট, ও আত্মস্থ, তাই ওর চলনে বলনে নম্রতার মধ্যেও অহংকারের ছায়া?
না কি সবটাই আমার মনের ভ্রম?
.
দিদি স্নানের ঘরে থাকতে থাকতেই জামাইবাবু বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
এসেই যে আমার সন্ধান করবে তা জানতাম। করলও তাই। রান্নাঘরের দরজায় উঁকি মেরে বলে উঠল, আরে ব্যস, উষাকালেই অন্নপূর্ণা মূর্তি! কচুরি, হালুয়া, আলুর দম, বাঃ বাঃ বেড়ে।…রাত্তিরে ঘুমিয়েছ, না কি বিনিদ্র রজনী কেটেছে কচুরির ডাল বেটে?
রাগ দেখিয়ে বললাম, কেন, আমি কি এমনি কুঁড়ে যে ওই সামান্য কাজটুকুর জন্যে রজনী বিনিদ্র করতে হবে?
প্রিয়মাধব হেসে বললেন, তা নও বটে। তবে তোমার দিদির নিশ্চিত এই এতগুলি ব্যাপার ঘটিয়ে তুলতে দুরাত জাগতে হত।
আমি আবার রাগ দেখালাম, ভাল হবে না জামাইবাবু, দিদিকে বলে দেব।
ওদিক থেকে দিদির গলা শোনা গেল। বলে দিতে হবে না, সব শুনতে পাচ্ছি।
প্রিয়মাধব হা হা করে হেসে উঠে বললেন, তার মানে পাহারা দিচ্ছ?
দিদি তেমনি গলায় বলে উঠল, তা দেওয়াই তো উচিত, তোমাকে বিশ্বাস কী? যে লোভী তুমি! হয়তো মুখ না ধুয়েই বলে বসবে, দেখি দুখানা গরম গরম!
ঈশ্বর জানেন, কেন হঠাৎ চড়াৎ করে ভয়ানক একটা অপমানের অনুভূতিতে আমার পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে উঠল। মনে হল দিদির এই সরল সাজাটা সম্পূর্ণ ছল। ও আমাদের দুজনকেই ব্যঙ্গ করল।
ওই অপমানের অনুভূতি কি শুধু একদিন? একবার?
প্রতিদিন, যে কোনও মূহুর্তে নয়?
দিদি যে আমাদের উপর পাহারা দিত না, আমাদের সন্দেহ করত না, এইটাই আমায় খেপিয়ে তুলত। আমি জোর করে করে বলেছি, দেখ দিদি, অত বিশ্বাস ভাল নয়।
দিদি ঠাট্টা ভেবে হেসেছে।
প্রিয়মাধবও বলত ঠাট্টা। তবে বেশিরভাগ আড়ালেই বলত, তোমার ঠাট্টাগুলো বড় কড়া শালি, আমি কড়া চোখে তাকিয়ে বলতাম, কে বললে ঠাট্টা?
সত্যি হলে তো আরও বিপজ্জনক কড়া, বলে পালাত। সত্যি শোনবার সাহস ছিল না।
.
তবু আমি ওই চা বাগানের কোয়ার্টার্সে প্রথম প্রথম ভালই ছিলাম। আমি যেন সহসাই আমার অতীত কৈশোরকে ফিরে পেয়েছিলাম।
আমি কবিতা লিখেছি তখন, গান গেয়েছি, আবৃত্তি করেছি। আমি তখন অকারণে চঞ্চল হয়েছি।
দিদি আমার এই স্ফুর্তির মূর্তি দেখে আনন্দে বিগলিত হয়েছে। বলেছে–মনে হচ্ছে কি জানিসনমু, আমরা যেন সেই আমাদের ছেলেবেলায় ফিরে গেছি। কী ভালই যে লাগছে!
আমি ভাবতাম, তোর ওই প্রিয়মাধবটি না থাকলে কেমন ভাল লাগত দেখতাম! তোর ভরাট মনের উপর আমি হচ্ছি ফাউ। চাঁদের উপর চুড়ো, নৈবিদ্যির উপর মণ্ডা। ছেলেবেলা। ছেলেবেলায় ও ছিল তোর প্রাণ জুড়িয়ে?
কিন্তু আমার সব কথাই তো মনের মধ্যে। তাই দিদি অবোধ থাকে। দিদি আমাকে আমার কৈশোর কালের স্বাদ দিতে চায়। তাই
.
দিদি আমার হাতে ধরে মিনতি করেছে ওদের সঙ্গে মাছ-মাংস খেতে, ওর শাড়ি থেকে রঙিন শাড়ি পরতে। বলেছে, মনে কর না ভাই, তুই কুমারীই আছিস। তোর সেই অতীতটা কিছু নয়। শুধু একটা বিরাট স্বপ্ন মায়া।
বলত, তার কারণ দিদি খেয়ে-পরে সুখ পেত না।
কিন্তু আমি খেয়ে-পরে দিদিকে খাওয়া-পরার সুখ দিতে যাব কেন?
সেই সুখ দেওয়া মানেই তো দিদির হাতের মুঠোয় চলে যাওয়া। দিদির প্রজা হয়ে যাওয়া। সেই সস্তা হতে আমি রাজি হইনি। আমি আমার আলাদা খাওয়া-পরার বর্মের মধ্যে একটা আলাদা সত্তা হয়ে বিরাজিত থাকব দিদির প্রিয়মাধবের সামনে।
.
প্রিয়মাধবকে আমি বুঝতে পারতাম না। মস্ত বড় একটি অভিনেতা ও, তাতে আর সন্দেহ কি? কিন্তু সেই অভিনয়টা কার সঙ্গে করত ও? বারে বারে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি আমি, বারে বারে বিভ্রান্ত হয়েছি।
কখনও ওর চোখে গভীর আবেগের গোপন ছায়া, কখনও সহজ কৌতুকের সহজ আলো, কখনও মনে হত ও ওই স্তিমিত-চিত্ত সুমিতা দেবীতে ক্লান্ত। কখনও মনে হত, ওখানেই ও নিমগ্ন।
অবিরত এই আলোছায়ার মধ্যে থেকেছি আমি।
কিন্তু আমি নিজে কী চাইতাম?
সে কথা আমি জানি না। আমার চাওয়া চিরদিনই আমার সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের খেলা খেলেছে।
আমি যখন সেই গভীর ছায়ার আভাস দেখতাম, কৌতুকের ছুরি বিধিয়ে দীর্ণ করতাম তাকে। যখন সেখানে স্বচ্ছ দীপ্তির আলো দেখতাম, আমি বাঁচাল হতাম, বেহায়া হতাম, এগিয়ে যাবার ভান করতাম।
.
আবার দিদির মনস্তত্ত্বও মাঝে মাঝে অবোধ হত। দিদি যেন ইচ্ছে করে এগিয়ে দিত আমায়, বলত, ওই রে সাহেব চেঁচামেচি লাগাচ্ছে, দেখ না ভাই কী বলছে! আমি আর পারি না উঠতে।
বলত, তুই বাবা বলে কয়ে বেশি খাওয়াতে পারিস, তুই-ই খাওয়া।
এটা কেন?
এটার মানে কী?
দিদি কি আমার উপবাসী চিত্তকে এক মুঠি খুদের খোরাক দিতে চায়?
না, ওর বরের মনোরঞ্জন করতে চায়?
সুমিতা দেবীর ওই স্তিমিত আর সীমিত সত্তা দিয়ে প্রচুর প্রাণ প্রিয়মাধবের দেহ মন দুইয়ের চাহিদা মিটছে না সন্দেহে এই প্রয়াস ওর?
.
এক এক সময় সন্দেহ হত, এই উদ্দেশ্যেই হয়তো দিদি আমাকে আমার কেন্দ্রচ্যুত করে নিয়ে এসেছে। এই বন্ধু-সমাজহীন অরণ্যে, প্রিয়মাধবের মতো প্রবল-প্রাণের মানুষকে ও নিজে একা ভরে রাখতে পারবে না, বেঁধে রাখতে পারবে না, তাই বলতে পেরেছিল, তোমাকে নমি ভালবাসে, তুমি বললেই যাবে।
যার অনেক ঐশ্বর্য তার আবার খানিকটা দিতে কী? ফেলে ছড়িয়েও তো ষোলো আনা থাকে তার।