দিদি আবার হেসে ফেলে।
বাবাঃ, এতও জানিস তুই। দিদি তবু পাতা বিছানাটাতেই বসে গড়ানে ভঙ্গিতে বলে, বেশ ঠিকঠাক আছে, শুয়ে পড়-না বাবা!
আমাকে অতএব রাগ দেখাতে হয়। বলতেই হয়, ম্যানেজার সাহেব, আমাকে এই দণ্ডে স্টেশনে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিন। নচেৎ গিয়ে খাদে পড়তে হবে।
বাবাঃ। বাবাঃ। দিদি উঠে পড়ে বোকা বোকা অপ্রতিভ হাসি হেসে বলে, একদিন এদিক-ওদিকে কী হয় শুনি?
কী হয়?আমি প্রিয়মাধবের দিকে চোরা কটাক্ষ হেনে বলি, হয়–অভিসম্পাত। কী দরকার বাবা সে অভিশাপ কুড়িয়ে? একে তো পূর্বজন্মে না জানি কোন ক্রৌঞ্চহত্যার পাপে এ জন্মে এই দুর্গতি! আবার এই পাপে
দিদি বালিশটা হাতে ধরে উঠে পড়ে।
শুধু বালিশ নিচ্ছিস? চৌকি বিছানা?
দিদির মুখে নবোঢ়ার রক্তিম ছাপ পড়ে। লজ্জা লজ্জা হেসে বলে, একদিন যা হোক করে হয়ে যাবে, কে আবার এখন অত টানাটানি করে?
দিদির সেই যা হোক করে কাটানোর উপকরণের দিকে তাকালুম। ফুট তিনেকের বেশি চওড়া নয় প্রিয়মাধবের চৌকিটা।
আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে প্রিয়মাধব বললেন, তার মানে আমাকে চৌকি থেকে ফেলে দেবেন আর কি!
ওদের এই লীলা রঙ্গে ভারী রাগ হল। বললাম, দিদি, দয়া করে শুয়ে পড়বি? ঘুমে মরে যাচ্ছি যে আমি!
দিদি এবার তাড়াতাড়ি উঠল। তবু
ভাব দেখাচ্ছে কতই যেন কষ্ট হচ্ছে আমার জন্যে। অন্য ঘরে বিছানা করে ফেলে মুখ তো শুকিয়ে গিয়েছিল। বুঝি না আমি? সব ছল। সব সাজানো। এক্ষুনি গিয়ে ও ওই প্রিয়মাধবের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে
বলবে, বাঁচলাম।
তুই আগে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ কর। তবে যাব আমি, বলল দিদি।
আমি বললাম, আমার দেরি আছে।
ওমা এখন আবার কী করবি তুই?
বাড়ির বিধবা গিন্নির ধরনে বললাম, আমি সকালের জলখাবারের ব্যবস্থা করে রাখব।
অ্যাঁ! বলিস কী? ও কাল সকালেই হবে। এই যে বললি ঘুমে মরে যাচ্ছিস?
যাচ্ছিলাম, এখন আর যাচ্ছি না। তা তুই বুঝি আমার দরজায় তালা লাগাবার জন্যে শুতে পারছিস না?
ধ্যেৎ, বলে দিদি যেন অগত্যাই ঘরে ঢুকে পড়ল।
বরের ঘরে।
আস্তে দরজাটা ভেজিয়ে দিল।
সন্তর্পণে খিলটা লাগাল। তবু খুট করে একটু শব্দ হল। শব্দটা বিষের মতো লাগল।
আমি অনেকক্ষণ ওই বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম ঈর্ষাতুর দৃষ্টিতে।
তারপর শব্দ করে খিল লাগালাম আমার ঘরে।
.
পরদিন ইচ্ছে করেই একেবারে অন্ধকার ভোরে উঠে পড়ে কাজে লেগে গেলাম। নতুন পত্তন সংসারে কাজের অভাব ছিল না, তা ছাড়া কাজ তো আর টাকা নয় যে, অভাব থাকলে অভাবই।
কাজের অভাব থাকলে কাজ সৃষ্টি করে নিতে কতক্ষণ? আমি যদি সকালের চায়ের উপকরণ হিসেবে কোনও একটা শৌখিন খাবার করতে বসি, বেশ কেটে যাবে সময়।
কাটল সময়।
আকাশের আবছা অন্ধকারও কাটল।
আলোয় ঝকমক করে উঠল বাড়িটা।
তখনও ওদের ঘরের দরজা বন্ধ। একটা দাসী এসে ঝটপাট শুরু করল, এবং আশ্বাস দিল আর একজন এক্ষুনি এসে পড়বে।
কী যে কাজ করবে দু দুটো দস্যি মেয়ে, কে জানে! কথাটা কাউকে বলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কে শুনছে? বাড়ির যাঁরা মালিক, কর্তগিন্নি তো এখনও সুখনিদ্রায় অভিভূত।
বেহায়া!
নির্লজ্জ।
ঢং করে আবার অন্যঘরে বিছানা পাতা হয়েছিল।
ইচ্ছে হচ্ছিল ওই বন্ধ দরজার উপর গুম গুম করে কিল মেরে চেঁচিয়ে বলি, কী গো লজ্জাবতী লতা! বর ছেড়ে অন্যত্র শুচ্ছিলে না তুমি? লজ্জার বালাই তো খেয়ে বসে আছ! লজ্জা করছে না এই অজানা অচেনা জায়গায় হঠাৎ এসে পড়ে সব ভার একটা মানুষের উপর ছেড়ে দিয়ে বাসরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে দুপুরের রোদ দেখতে!
ইচ্ছে হচ্ছিল।
অথচ তা করিনি আমি। যা করেছিলাম তা যে-কেউ শুনলে গালে হাত দিত। আমিও জানি না ওই দুরন্ত রাগের সময় কী করে আমি সকালের রোদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গুগুন্ করে গান গাইছিলাম। অথচ গাইছিলাম।
একটু পরে দিদি উঠে এল।
সত্যিই নতুন কনের মতো লজ্জা লজ্জা মুখে এসে দাঁড়িয়ে কুণ্ঠিত হাসি হেসে কৈফিয়তের সুরে বলল,ইস কী বেলাই হয়ে গেল! তুই তো কখন উঠেছিস, আমায় একটু ডেকে দিসনি কেন?
আমি ভুরু তুলে বললাম, আমি যে কোন উঠেছি, সেটা কী করে জানলে?
দিদি বলল, ওমা শোনো কথা! কাজই পরিচয়। অনেক আগে না উঠলে কখনও কচুরি ভাজা যায়?
খুব কড়া একটা কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল, তবু সামলে নিয়ে বললাম, আমি মন্ত্রবলে এক নিমেষে সব করে ফেলতে পারি।
ইস তাই বইকী! বলে ছেলেমানুষের মতো হাসল দিদি।
দাঁড়িয়ে থাকল একটু বোকার মতো, তারপর স্নানের ঘরের দিকে চলে গেল।
পাহাড়ি দেশের বাড়ি, দেয়াল জোড়া, শার্সির জানলা, বারান্দার এক দিকটা তো পুরো কাঁচের। বারান্দার রেলিংগুলো হালকা কাঠের, মেঝেগুলো মসৃণ সবুজ। কিন্তু মেঝের রং কতটুকুই বা দেখা যাচ্ছে, প্রায় সর্বত্রই তো কার্পেট বিছানো।
রান্নাঘর ভাঁড়ারঘর?
সেও কাঠ পাতা।
দিদি চলে গেল বোকার মতো, ছেলেমানুষের মতো। তবু ওই কাঁচের মধ্যে থেকে এসে পড়া আলোয় ওকে যেন সম্রাজ্ঞীর মতো মনে হল। আমার নিজের হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গিটা কেমন আমি জানি না। তবু কোনওদিনই আমি দিদির মতো কুণ্ঠিত অপ্রতিভ কি ন নম্র ভঙ্গিতে হাঁটি না। শ্বশুরবাড়িতে থাকতে পর্যন্ত হাঁটাচলায় ইচ্ছে করে আনতাম দৃপ্তভঙ্গি।
তবু দিদির ওই হেঁটে যাওয়াটা দেখে মনে হল, আমার ঠিক এরকমটা যেন না হয়।…