তবে তটস্থ হবার ব্যাপারে এতটুকু ত্রুটি দেখাল না। আমাকেও ত্রুটি করল না। অবশ্য আমার মনে হল আমাকে নিশ্চয় মেমসাহেবের আয়া ভাবছে ওরা।
ম্যানেজারের বাংলোর দিকে চললাম আমরা, আস্তে গাড়ি চালিয়ে। এই পথ দিয়ে যেতে সমস্ত উপত্যকাভূমি দেখা যাচ্ছে, নীচে গভীর খাদ অবধি চা বাগান। চা বাগান! চির পরিচিত শব্দ। অথচ চির অপরিচিত দৃশ্য। দিগন্ত বিস্তৃত সেই সিঁড়িকাটা বাগানের হরিৎ আর গাঢ় সবুজের শ্যামল শোভা যেন চিত্তের সমস্ত গ্লানি মুছে দিতে চেয়ে মেহদৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।
চা বাগানের এই সুবজ শোভা নাকি হতভাগ্য মানুষদের রক্তের লালের পরিবর্ত।
কিন্তু সে কথা এখন বোঝা যাচ্ছে না। ওর থেকে চোখ তুললেই তো থাকের পর থাক পড়ে রয়েছে হিমালয়ের ছোট ছোট গিরিচূড়া, তারও উপরে একেবারে আকাশের কোণে তুষারমৌলী গিরিরাজ চিরসুন্দর, চিরপবিত্র।
হঠাৎ দেখলে সেই পবিত্রতা আর শুভ্রতাটুকুই মনে ছাপ দেয়।
মনে হল দিদি ঠিকই বলেছে।
প্রকৃতির কোলই বটে।
সেই প্রকৃতির কোলে
বেশ রাজকীয় সম্মানেই ম্যানেজার সাহেবের বাংলোয় প্রবেশ করলাম আমরা। সাহেব মেমসাহেব, আর তাঁদের স্নেহপাত্রী দুঃখিনী আশ্রিতা। না, সেই পরিবেশে তখন ও ছাড়া নিজেকে আর কিছুই ভাবতে পারিনি আমি।
কিন্তু বাংলোর মধ্যে এসে জিনিসপত্র ছড়িয়ে দিদি যখন এলিয়ে পড়ল, এবং কোম্পানি নিয়োজিত অসমিয়া দুটো চাকরানীর বহুবিধ কথার কোনও উত্তরই দিয়ে উঠতে পারল না, তখন আমাকেই হাল ধরতে হল।
আর তখন ধীরে ধীরে দিদিই যেন আমার আশ্রয়ে এসে পড়া বেচারিতে পরিণত হয়ে উঠল।
.
কাজের মধ্যে সহজ হয়ে গেলাম আমি।
ডাক-হাঁক শুরু করলাম। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সামান্য কাজে হইচই, সামান্য কথায় তোলপাড় হাসি, এটা যেন আপনি এসে গেল। গোছগাছ নিয়ে দিদির শিথিলতা, জামাইবাবুর হইচই এবং আমার ম্যানেজমেন্ট, বাংলোকে বেশ সরগরম করে তুলল।
জামাইবাবু বলল, শালিকে আবার যেন শালি শালি মনে হচ্ছে।
হঠাৎ যেন আমিও আমার সাজটা ভুলে গেলাম। ভুলে গেলাম অবস্থা। মনে হল দিদির বিয়ের ঠিক পরের সেই নমিতা আমি। যে নমিতা ছিল অকারণেই চঞ্চল। যে কথায় কথায় হাসত, কথায় কথায় গান গেয়ে উঠত, কবিতা পড়ত আর কবিতা লিখত।
মনে হল, আবার হয়তো কবিতা লিখতে পারব আমি।
দিদি আমার এই কিশোরী মূর্তি দেখে কি অবাক হল? না শুধুই খুশি হল?
জানি না কী হল আর না হল, তবে দিদির একটি কীর্তি দেখে আমি অবাক হলাম শুধু। দিদি যে ভিতরে ভিতরে এই মতলব করছে, তা কে জানত।
.
আমি যখন রান্নায় ব্যস্ত, দিদি তখন কোম্পানির ওই চাকরানী দুটোকে দিয়ে বেডিং খুলিয়ে বিছানা পাতিয়েছে। একটা ঘরে জোড়াচৌকিতে দিদির আর আমার, পাশের ঘরে একা জামাইবাবুর।
শুতে এসে আমি তো থ!
হইচই করে উঠতেই হল।
বললাম, ম্যানেজার সাহেব, এটা কী?
জামাইবাবু এই নতুন সম্বোধনে হেসে উঠে বলল, এটা মোেটই আমার ম্যানেজমেন্টের অবদান নয়। এ সম্পূর্ণ মেমসাহেবের ব্যাপার।
তা আপনি তো ছিলেন এখানে?
ছিলাম। দর্শক হিসেবে।
অথবা বলির ছাগ হিসেবে হেসে উঠলাম আমি। দিদিকে ডাক দিলাম। ধীরে সুস্থিরে দিদি আস্তে আসছিল খাবার ঘর থেকে, বারান্দা পার হয়ে।
তীব্র তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করলাম, দিদি, এটা কী?
দিদি মিষ্টি হেসে বলল, সুমিতা দেবী এবং নমিতা দেবীর সুখশয্যা।
ওঃ! তাই বুঝি? তা শ্রীমতী সুমিতা দেবী, চা-বাগানের ম্যানেজার সাহেব রাতারাতি আমাকে ধরে তুলে খাদে ফেলে দিয়ে আসুন, এই তা হলে চান আপনি?
দিদি অপ্রতিভ হাসি হেসে বলল, বাঃ, তুই তা হলে এই নতুন দেশে একলা শুবি না কি?
আমি গম্ভীরভাবে বললাম, অবিশ্বাস হয়, দোরে চাবি লাগিয়ে চাবিটা নিয়ে শুয়ো। সকালে খুলে দিলেই হবে। রাতে আমার ঘুম ভাঙে না।
দিদি অবাক হয়ে বলল, অবিশ্বাস মানে? শুনছ গো, নমির কথা?
জামাইবাবু বলল, শুনছি বইকী! যত শুছি, তত মোহিত হচ্ছি।
দিদি বলল, অবিশ্বাসের জন্যে একা শুতে দেব না, এমন অনাসৃষ্টি কথা তোর মাথাতেই আসা সম্ভব। তুই এই অজানা অচেনা জায়গায় একা একটা ঘরে থাকবি, এতে আমার স্বস্তি আসবে?
বললাম, দিদি, স্বস্তি জিনিসটা একা তোরই প্রাপ্য সর্বদা এটা ভাবিস না! তা ছাড়া বিধাতার উপর হাত চালাবি তুই? সে যাকে একা থাকার বিধান দিয়েছে, তুই যাবি তার শয়নসঙ্গী হতে? পাগলামি করিস না, যা। যা-না, তোর বালিশ-বিছানা উঠিয়ে দিচ্ছি চল।
প্রিয়মাধব এতক্ষণ সকৌতুকে এ দৃশ্য উপভোগ করছিলেন। হেসে বললেন, থাক থাক, শালি, আজ যখন সুখশয্যা রচনা করা হয়েছে, ওটাই চলুক।
না, চলবে না। আমি দৃঢ় হলাম, যা অচল, তা একদিনই বা চলবে কেন? দিদি আরও অপ্রতিভ গলায় বলল, রাত্তিরে তোর ভয় করবে দেখিস।
দেখব! ভয়টাও তো একটা দ্রষ্টব্য। হেসে বললাম আমি, ভয়ানক একটা কিছু দান করে বসতে নেই রে দিদি, শেষে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করবে।
দিদি তবু অনুরোধ করে। তবু ছেলেমানুষের মতো করতে থাকে।
আমি যেন নতুন কনেকে বরের ঘরে শুতে যেতে সাধছি। দিদি বলে, আহা, ভারী একেবারে ভয়ানক! পাঁচ বছর বিয়ে হয়ে গেছে।
আমি বলি, তোর কথাটা কেমন হল জানিস? আহা, বড্ড একেবারে তেষ্টা। জন্মাবধি জল খাচ্ছি।
দিদি হেসে ফেলে বলে, আমার অত নেই, যাঃ।
তা না হয় নেই, তুই না হয় মহামানবী। কিন্তু যে বেচারি বলির ছাগের ভূমিকা নিয়ে বসে আছে?