যেখান থেকে আগ্রহের অনুরোধ এল, স্থির থাকা শক্ত হল আমার। রক্তের মধ্যে এল চাঞ্চল্যের জোয়ার।
তখন কি জানতাম ছাই, ওই আগ্রহের অনুরোধ এসেছিল দিদির নির্দেশে? দিদির কৌশল ওটা?
জানতাম না।
ভেবেছিলাম এ ওরই গোপন আগ্রহ। আমার সাজবদলে দিদি বসে পড়েছিল। আর জামাইবাবু আড়ালে শুকনো মুখে বলেছিল, একটু ঠাট্টা-আহ্লাদ করে বাঁচতাম শালি, সে পথও ঘোচালে! দেখে ভয় ভয় করছে।
বললাম, সবই তো এহ বাহ্য।
তবু মনে হচ্ছে তুমি যেন দূর আকাশের তারা হয়ে গেলে?
ভালই তো, ঊর্ধ্বমুখে চেয়ে থাকবেন, আর অর্ঘ্য দেবেন।
জামাইবাবু বলেছিল, দূর এ যেন অসহ্য।
তারপর ও আমায় ঠকাল।
ওর ভালবাসার বউয়ের নির্দেশে আমায় ভালবাসা জানাতে এল।
অনেকদিন পরে জেনেছি আমি, দিদির অনুরোধেই আমায় অনুরোধ করেছিল ও। দিদি বলেছিল, জানো তো ও তোমায় কত ভালবাসে, তোমার কথা এড়াতে পারবে না।
সেই কথার জাল ফেলতে এল ও।
বলল, নমু, চল-না আমাদের সঙ্গে।
নমু ডাক ও কবে ডেকেছে?
চমকে গেলাম।
বললাম, কেন? খাল কেটে কুমির নিয়ে যাবার ইচ্ছে কেন?
ও বলল, তা কেন? খাল কেটে গঙ্গা নিয়ে যেতে চাইছি।
হেসে ফেলে বললাম, ওটা তো সাজানো কথা। ডাইনে বাঁয়ে চিনির নৈবিদ্যি, সেটাই বলুন। সেটা বলতে পারলে তো বেঁচে যেতাম! প্রিয়মাধব তার নামের অর্থ বহন করে চোখে চোখে তাকাল। বললে, কদিনই বা বলতে পেলাম? সুখের দিনগুলো বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল।
ওই দৃষ্টিতে সম্মোহিত হয়েছিলাম আমি।
তাই ওদের সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে গেলাম। পরে ভেবেছি, ওই দৃষ্টি কি অভিনয়? না কি সত্যি?
সত্যি যদি তো স্ত্রীর অনুরোধে অনুরোধ করতে এসেছিল কেন ও? অভিনয় তবে কার সঙ্গে করেছিল? আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না ওর কোনটা সত্যি, কোনটা অভিনয়। না কি নিজেই জানে না ও? হয়তো তাই! ওর অগাধ প্রাণপ্রাচুর্য ওকে হয়তো সীমারেখার মধ্যে স্থির থাকতে দিত না।
আমি রাজি হয়েছি দেখে দিদি যেন কৃতার্থ হল।
দিদি এসে আমার শাশুড়ির কাছে আবেদন করল।
শাশুড়ি বলল, নিয়ে যাবে তো যাও মা, বাঁচি আমি। ওই আগুনের খাপরাকে বুকে নিয়ে সারাজীবন বইতে হবে আমায়, ভেবে ভয়ে মরে যাচ্ছি।
আমি বললাম, আপনার কি ধারণা চিরদিনের জন্যে বোনের বাড়ি থাকতে যাচ্ছি আমি?…যখন ইচ্ছে হবে চলে আসব।
শাশুড়ি নিশ্বাস ফেলল। বোধহয় নিজের ভবিষ্যৎ ভেবে।
কিন্তু জামাইবাবু সে পথ ঘোচাল আমার। আমার দেওরদের সঙ্গে ভাগ-ভিন্ন করে, অধিকারচ্যুত করল আমায়। বলেছিলাম, দিদির সঙ্গে যে আমার চিরকাল বনবে তার গ্যারান্টি কে দিচ্ছে? যদি তেজ করে চলে আসি?
দিদি হেসে বলেছিল, তা বেশ তো, চলে আসিস। সিকদার বাগানের বাড়ির চাবি খুলে নিয়ে দিব্যি থাকবি। বাবার বাড়িটা তো বেচে খাইনি আমরা?
পিসি মরার পর পিসে অতএব তার ত্যাগ করে-আসা ভাইদের বাড়ি চলে গিয়েছিল, বাড়িটার নীচের তলায় ভাড়াটে বসিয়ে। দোতলাটা চাবি দেওয়া ছিল।
.
দেওররা বলল, হাড়ে বাতাস লাগল আমাদের।
শাশুড়ি বলল, বাঁচলাম।
এই পাথেয় নিয়ে ভগ্নিপতির আশ্রয়ে বসবাস করতে চললাম আমি।
এই জীবন আমার। অথচ দিদির সঙ্গে ওই এক ঘণ্টার তফাত ছাড়া আর কোনও বিষয়ে তফাত ছিল না আমার।
দিদির জন্মলগ্নটা কি এমনই এক শুভগ্রহের গতিপথের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছিল যে, দিদির জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই পিছলে পড়ে গিয়েছিল সে গ্রহ?
পর মুহূর্ত থেকে শুরু হয়েছিল কোনও এক কুটিল গ্রহের শাসনকাল?
.
গাড়িতে এমন আদর করে ওরা দুজনে নিয়ে গেল আমায়, যেন আমি এক মস্ত কুটুম যাচ্ছি, কি একটা রুণ শিশু যাচ্ছি। সেই অবস্থা সহ্য করতে হয়েছিল আমাকে।
ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল। আর আমার মুখে সেই ইচ্ছের ছাপ পড়ছিল খুব সম্ভব। অতএব ওরা আরও যত্ন করতে এগিয়ে আসছিল। ভাবছিল আহা বেচারা।
আমার তাপিত প্রাণে প্রলেপ লাগাতে ওরা প্রাণ ঢালছিল।
কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, আমি যে দুঃখী, আমি যে ভাগ্যবঞ্চিত, এ যেন ওরা ভুলতে দিতে রাজি নয়। ওরা ওদের মিলিত হাত বাড়িয়ে আমার সেবা করে করে অহরহ জাগরূক রাখবে সেটা।
হয়তো ওদের দোষ নয়, দোষী আমার বৈধব্যের বেশ।
আমার কাটা চুল, আমার খালি হাত, আমার থান কাপড়, ওদের ও কথা ভুলতে দিচ্ছিল না। ওরা বুঝতে পারছিল না, এই সাজ আমার ওদের প্রতি বিদ্রোহ। ভাবছিল বৈরাগ্য।
.
আমার বিদ্রোহ ছিল, ঔদ্ধত্য ছিল, ঈর্ষা ছিল, অহংকার ছিল, ছিল না শুধু লোভ জয় করবার শক্তি।
আমি নিজেকে ধিক্কার দিয়েছি, তবু অনিমেষ নয়নে সেই প্রিয় মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। যে মুখের অধিকারীর নাম সত্যিই প্রিয়।
প্রিয়মাধব।
অবশ্য এক-আধ সময় মমতার কাছেও হার মানিনি তা নয়।
দিদি যখন আমায় মমতা করতে হৃদয় বাড়াত, সে হৃদয়কে দুহাত দিয়ে ঠেলে ফেলে দেবার দুর্দমনীয় ইচ্ছে দমন করেছি তো শুধু মমতারই বশে।
.
চা বাগানের বহুবিঘ্নিত রাস্তার বহুবিধ দোলা এবং হৃদয় দ্বন্দ্বের দোলা, এই দুই দোলায় দুলতে দুলতে প্রিয়মাধব মুখার্জির কর্মস্থলে পৌঁছনো গেল।
সারি দিয়ে লোক এসেছিল সাহেব আর মেমসাহেবকে স্বাগত জানাতে। কলকাতার টি বোর্ডের একজন মাঝারি অফিসার কোন পাতাচাপা কপালের জোরে একেবারে একখানা বাগানের ম্যানেজার হয়ে আসে, তাই ছিল তখন বোধ করি এদের জল্পনার বিষয়।