জানি না কার জন্যে লিখছি আমি এসব।
প্রিয়মাধবের জন্যে?
তার ছেলের জন্যে?
না কি যে হারিয়ে গিয়েও না হেরে জিতে গেল, তার জন্যে?
হয়তো কারও জন্যেই লিখছি না।
শুধু প্রিয়মাধব যখন জিজ্ঞেস করে, রোজ কী লেখো? তখন বলি, আমি মরে গেলে দেখতে পাবে।
কিন্তু লিখছি তো এখন।
তখন তো লিখিনি।
যখন নমিতা নামের একটা ভয়ংকরী মেয়ে ছিলাম আমি।
কিন্তু তখনই কি লিখতাম না?
প্রেমের কবিতায় খাতা ভরাতাম না?
অজস্র সেই প্রেমের কবিতায় ভরা খাতাখানা একদিন আমার উকিল বরের হাতে পড়েনি?
উলটেপালটে দেখে বলেছিল সে, তোমার সংগ্রহশালাটি প্রশংসার যোগ্য নয়, যত রাজ্যের ওঁচা, অসভ্য কবিতাগুলো বেছে বেছে খাতায় তুলেছ?.
তাই ভেবেছিল ওপরের কবিতা নকল করে খাতায় তুলেছি।
তার বেশি দৌড় ছিল না ওর কল্পনার।
ওর মার যেমন একখানা খাতায় রাজ্যের স্তব-স্তোত্র বন্দনা-মহিমা ইত্যাদি ভোলা আছে, আমার খাতাটাকেও ও তাই ভেবেছিল।
আমি যখন সগর্বে বলেছিলাম, তোলা মানে? এ তো আমার নিজের লেখা–, একটু অনুকম্পা মিশ্রিত অবিশ্বাসের হাসি হেসেছিল উকিল।
তারপর বলেছিল, তা তোমার এরকম টেস্ট হওয়াই স্বাভাবিক। দেখেছি তো তোমার বাবার বইয়ের কালেকশান! একখানা ভাল বই নেই। ওই সব পড়েই তো মানুষ!
কিন্তু স্বর্গের দেবী সুমিতা দেবীও ওই বাড়িতেই মানুষ! তীব্র হাসি হেসে বলেছিলাম আমি।
হেমন্ত উকিল বলেছিল, ব্যতিক্রম! পৃথিবীতে ব্যতিক্রম থাকেই।
কবিতা লিখেছি আমি ছেলেবেলায় দু-চারটে, বেশির ভাগ দিদির বিয়ের পর।
আগেরগুলো লিখেই তৎক্ষণাৎ দিদিকে দেখাতাম। পরে কদাচিৎ!
মনে হত অরসিকেযু রসস্য নিবেদন-এ কাজ কী?
তবে জামাইবাবুর আসবার কথা থাকলে ইচ্ছে করে টেবিলে কি খাটে ফেলে রেখেছি।
জামাইবাবুর চোখে পড়ে গেলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়ত, আর দিদিকে ডাকত, দেখো গো দেখো, তোমার বোনের কাব্য। হৃদয় একেবারে রসভারে টলটল করছে।
দিদি বলত, তুই নিজে লিখেছিস? সত্যি? আশ্চর্য!
আশ্চর্যই হয়েছে দিদি, সন্দেহ করেনি কখনও।
অথচ দিদি
কী বলেছিল তখন দিদি
হ্যাঁ, তখন দিদি বলেছিল, তুই ছাড়া আমার আর কে আছে নমু?
বললাম, দিদি, এদের কাছ থেকে চলে যাওয়া মানে তো লড়াইয়ে হেরে পালিয়ে যাওয়া।
দিদি বলল, তা হোক! ঝগড়ায় হারা ভাল। মনে নেই ছেলেবেলায় পিসি বলত, কিছুতে হেরো না, ঝগড়ায় হেরো।
পিসি!
দিদির এই পিসি সেন্টিমেন্টে বরাবর হেসে উঠতাম আমি, কিন্তু সম্প্রতি পিসি মারা গেছে, তাই হাসলাম না।
বললাম, কিন্তু তোর বাড়িতে নিয়ে যাবার পিছনে যুক্তি কী? আমি ছাড়া তোর কেউ নেই বলে? লোকে শুনলে হাসবে।
লোকের হাসিতে কী আসছে যাচ্ছে?
দিদি বলেছিল, দুঃখের সময় সুখবর বলতে পারিনি। তোর জামাইবাবুর অন্য একটা কাজ হয়েছে। চা বাগানের ম্যানেজারি।
চা বাগানের ম্যানেজারি!
কাজটাকে খুব একটা ভাল এবং খবরটাকে বেশ একটা সুখবর বলে ভাবিনি আমি। কিন্তু দিদির ওই আহ্লাদে জ্বলজ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হয়েছিল সে কথা বলতে।
দিদি তারপর অনেক কথা বলেছিল। বলেছিল
কখনও তো কোথাও যাইনি আমরা, বিদেশ কেমন তা চক্ষে দেখিনি। আমি তবু জন্মের মধ্যে কর্ম একবার দিল্লি আগ্রা বৃন্দাবন, তুই তাও না।
এই সব কূটকচালে আত্মীয়-স্বজনদের আওতা থেকে সরে গিয়ে ভালই থাকব আমরা। একেবারে প্রকৃতির কোলে শান্ত পরিবেশে থাকব, কেউ আমাদের জীবনের জানলায় উঁকি দিতে আসবে না।
এমনি সব অনেক কথা অগোছালো করে বলেছিল দিদি।
আর তার মধ্যেই দিদির ভালবাসার মনের ইচ্ছে বারবার উঁকি দিয়েছিল।
দিদি নিজে না বুঝলেও, আমি বুঝেছিলাম দিদির সেই বড় স্নেহের বড় ভালবাসার ছোট্ট বোনটা যে এই বয়েসে সর্বত্যাগিনী হয়ে বসে থাকবে, এ দিদির সহ্য হচ্ছিল না, তাই দিদির ইচ্ছে উঁকি দিচ্ছিল সমাজ-সংসারের চোখের আড়ালে নিয়ে গিয়ে তাকে নিয়মবন্ধন থেকে মুক্ত করে দেবে।
ওর সেই ভালবাসার মনের ইচ্ছেটি কথার ফুল হয়ে ফুটে উঠছিল, এখানে থাকলে তোর ওই শাশুড়িবুড়ি নির্ঘাত তোকে নিয়ে যা তা করবে। কিন্তু তুই তো বলতে গেলে কুমারীই আছিস। বরের সঙ্গে কদিনই বা ঘর করেছিস, আর কতই বা মিশেছিস? তুই খাবি পরবি সবই করবি।
.
খাওয়া-পরা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মাধ্যমে দিদি আমার বৈধব্যযন্ত্রণার লাঘব চেয়েছিল। হয়তো ভেবেছিল তবু সেটাই লাভ।
আর সেই লাভটুকু পেতে আসামের জঙ্গলও আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল দিদির।
কিন্তু দিদির সেই ছেলেমানুষীকে প্রশ্রয় দিইনি আমি। আমি অশৌচান্তেই সাদা থান সার করেছিলাম, হাত শুধু করেছিলাম, কোমর ছড়ানো চুলগুলোর অর্ধেক নির্মূল করে ফেলেছিলাম।
দিদি সেই মূর্তি দেখে বসে পড়েছিল। বলেছিল, হেমন্তকে তো তুই এত ভালবাসতিস না নমু যে, তার জন্যে সর্বত্যাগিনী হবি?
দিদির দুঃখ দেখে মন কেমন করেনি তা নয়, কিন্তু দিদির ভালবাসার পুতুল হয়ে থাকতে মন ক্রমশ বিদ্রোহী হয়ে উঠছিল আমার।
ওর ওই স্নেহের ভার ক্রমশই ভার হয়ে উঠছিল আমার কাছে।
দিদি আমায় ভালবাসবে, মমতা করবে, করুণা করবে, আহাকরবে, আর আমি দিদিকে ঈর্ষা করব, এ অসহ্য!
দিদি যদি আমায় এত ভালবাসতে না আসত, এত আহা না করত, বাঁচতাম আমি।
.
ভেবেছিলাম ওদের সঙ্গে কিছুতেই যাব না। চলে যাক দিদি অনেক দূরে।
তার সুখ, সমৃদ্ধ, ভালবাসার বর, আর বরের ভালবাসা নিয়ে। আমি এখানে লড়াই করে বেঁচে থাকব। কিন্তু আশ্চর্য! তবু গেলাম আমি দিদির সঙ্গে। আমার অহংকারকে পরাস্ত করে লোভ জয়ী হল। থান কাপড় আর শুধু হাত আমাকে রক্ষা করতে পারল না।