এই সুযোগটা নিত তার স্ত্রীর দিদি। প্রায়ই গাড়ি ভাড়া করে শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ছুটত, আর গিয়ে বলত, ভাই হেমন্ত, আজ একটু বউকে ছাড়তে হবে।
হেমন্তর মন ভিজোতে আরও বলত, যমজ বোন বুঝতেই তো পারছ। ও না ভোগ করলে আমার ভোগ হয় না। রাগ কোরো না ভাই।
যেন অনুমতি না নিয়ে উঠবে না। অথচ রাগ করত না হেমন্ত। এক কথাতেই অনুমতি দিত। পরে হেমন্ত নমিতাকে বলত, আশ্চর্য! তোমার যমজ বোন উনি, এ যেন বিশ্বাসই হয় না। দেবী আর উর্বশী।
নমিতা রেগে রেগে বলত, বিধাতার কারসাজি। নইলে আর কটাদিন আগে তোমা হেন দেবতা যদি আমাদের গার্জেনের চোখে পড়ত গো, ইতিহাস বদলে যেত।
হেমন্ত বলত, আমার পূর্বজন্মের পুণ্য ছিল না, তাই চোখে পড়েনি!
৩. দাহ অনুভব
নমিতা দাহ অনুভব করত।
কিন্তু সে দাহ বেশিদিন রইল না।
নমিতার ভাগ্য নমিতাকে একটা কাঁটাবনে নিয়ে গিয়ে আছড়ে ফেলল।
হেমন্ত নামের ওই বিরক্তি উৎপাদনকারী সম্পূর্ণ অপছন্দের বরটাও ভাগ্যে বেশিদিন টিকল না তার, মারা গেল।
হঠাৎই মারা গেল।
ডাক্তার বলল কলেরা। হেমন্তর মা বলল, হারামজাদী বউ বিষ খাইয়েছে।
ছবির মতো চেহারার তরুণী বউ। ঔদ্ধত্য আর বাঁচালতা ছাড়া আর কোনও দোষ যার খুঁজে পাওয়া যায় না, বিনা দ্বিধায় তার নামে এই বদনাম রটিয়ে দিল শাশুড়ি।
.
কিন্তু নমিতা কি মরমে মরে গিয়েছিল?
অনেকদিন পরে কলম হাতে নিয়ে সেই নমিতাকে দেখতে দেখতে ভাবছি, কই? এত বড় অপবাদেও তো মরমে মরে যায়নি সে! মনের ঘেন্নায় নিজেই বিষ খেয়ে শোধ নিতে পারেনি তো?
তাই তো উচিত ছিল।
সাধারণ বাঙালির ঘরের মেয়ে তো তাই করত।
আর কোনও মেয়ে এত বড় অপবাদের পরও মুখ দেখাত কি? বিশেষ করে স্বামী মদ্যপ ছিল না, অসচ্চরিত্র ছিল না, স্ত্রীর প্রতি অবহেলা বা অত্যাচারকারীও ছিল না, শুধু একটু বেশি সিরিয়স ছিল।
জীবনকে সে রঙিন চশমা দিয়ে দেখত না তার বড় ভায়রা-ভাইয়ের মতো।
নমিতার প্রতি আকর্ষণের অভাব ছিল না তার। এবং নমিতার চপলতাটুকু অন্তর্হিত হলে হয়তো গলেই থাকত। সেই স্বামীর এই আকস্মিক মৃত্যুই তো যথেষ্ট মর্মান্তিক ছিল, তার উপর এই বিষের অপবাদ!
নমিতার নিজেরই বিষ খাওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু নমিতা বিষ খেল না।
বরং অভিযোগকারিণীর গায়ে বিষের ঝাপটা মারল।
বলল, খাইয়েছি যদি তো জেনেশুনে বসে আছেন কেন? পুলিশ-কেস করুন?
শাশুড়ি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে অন্য ছেলে দুটোকে ডেকে বউয়ের এই ভয়ংকর বাণী গোচরে আনল। নমিতা তাদেরও ওই এককথা বলল, জেনেশুনে পুলিশ-কেস করছ না কেন বলো তো? জেলে দাও ফাঁসি দাও, একটা কিছু করো।
তোমার মতন মেয়েমানুষকে তাই করাই উচিত, বলেছিল মেজ দেওর। আর সদ্য বিধবা নমিতা হেসে উঠে বলেছিল, তবু সেই উচিত কাজটা করছ না। তার মানে, ভাবছ ভালই হয়েছে, ষাঁড়ের শত্রু বাঘে মেরেছে, কেমন? দুখানা বাড়ি তিনটে ভাগীদার অসুবিধে হচ্ছিল তো!
হ্যাঁ, ওই ভাবেই ওদের বিষের ঝাঁপট মেরেছে নমিতা, অপবাদের শোধ নিয়েছে।
হয়তো ওই ভাবেই চালিয়ে যেত সে।
তার রুচিবোধ, কাব্যবোধ, শিল্প-সুষমা সব কিছুর বোধ জলাঞ্জলি দিয়ে শাশুড়ি আর দেওরদের সঙ্গে বিষের লড়াইয়ে জেতবার জন্যে মরণ পণ করত। ভাগ্য নামক পৈশাচিক বিধাতার উপর নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নিতে নিজেকে কুৎসিত কদাকার করে তুলত। তবু তাও হয়তো ভাল হত। কিন্তু তার জীবনের শনি দিদি তা করতে দিল না। দিদি তার বরকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কেঁদে পড়ল। বলল, এখানে থাকলে তুই বাঁচবি না নমু, আমার কাছে চল তুই।
তোমার কাছে, কী বল?
নমিতা হেসে উঠেছিল, তোমার সুখের সংসারে কালসাপ হয়ে ঢুকতে যাব আমি? তুমি পাগল না আমি পাগল?
সুমিতা বলল, তুই তো চিরকেলে পাগল! তোর কথা শুনব না। এই জিজ্ঞেস কর তোর জামাইবাবুকে, ও কী বলে শোন।
নমিতার তখনও অশৌচ চলছিল।
তখনও নমিতা বৈধব্যের বেশ গায়ে চড়ায়নি, শুধু চুলগুলো রুক্ষু হয়ে চেহারাতেও একটু রুক্ষতা এনেছিল।
তবু সুন্দরী দেখাচ্ছিল বইকী!
ঘরের মধ্যেকার বড় আরশিদার আলমারির পাল্লায় নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছিল নমিতা। নমিতা তাই মুচকি হাসি হেসেছিল, জামাইবাবু কি আমার গুরুদেব যে, যা বলবেন শুনতে হবে?
তা গুরুদেব না হোক, গুরুজন তো বটে। চিরদিন ভালবাসিস, ভক্তি করিস।
নমিতা হেসে উঠেছিল। সদ্য বিধবার মুখে সেই বাঁচালের হাসি মানায় কিনা খেয়াল করেনি।
নমিতা বলেছিল, ভালবাসার সঙ্গে ভক্তিটা জুড়ে বুঝি একটু মোলায়েম করছিস দিদি?
দিদি তবুও থতমত খায়নি।
আশ্চর্য মনোবল দিদির!
দিদি বলেছিল, তা ভালবাসা থাকলেই ভক্তি আসতে বাধ্য। ভক্তিশ্রদ্ধাহীন ভালবাসা আবার ভালবাসা নাকি?তারপর বলেছিল, তর্ক রাখ নমু, আমি বুঝতে পারছি এখানে থাকলে তুই বাঁচবি না।
তা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মেয়ের মধ্যে একটা মেয়ে না-হয় নাই বাঁচল।
দিদি কেঁদে ফেলল।
চাঁদের শুক্ল অংশের মতো যমজ দুই বোনর পবিত্র অংশটুকুর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল। বললে, তুই ছাড়া আমার আর কে আছে নমু?
যেন ওই নমু ওর থেকে বছর পাঁচ-দশের ছোট বোন।
.
ওই নমিতাটাকে আমি বলতে ইচ্ছে হয় না, তাই নমিতা বলে চলেছি।
যদিও জানি না কেন লিখছি এসব। হয়তো ভয়ংকর যে যন্ত্রণাটা কোনওদিন ফেটে পড়তে পায়নি, সে-ই আমাকে এই প্ররোচনা দিয়েছে।