.
দিদিরা বাসার খবর জেনেছিল।
দিদিরা স্টেশন থেকে সেই বাসায় এসে উঠল।
প্রথম দিন পিসিই রান্না করে দিতে এসেছিল।
আমিও সঙ্গে গিয়েছিলাম।
আমিই দিদিকে আগে দেখলাম জানলা থেকে।
দেখলাম, দিদি বেশ একটু বদলে গেছে। দিদি আর সেই পাতলা গড়নের রূপসী তরুণী নেই, যেন বেশ একখানি ভরাট-দেহ যুবতীতে পরিণত হয়েছে।
এই কদিনেই এত চেঞ্জ? ছিঃ!
হিংসে করব না অবজ্ঞা করব? দেহের এই ভরাটত্ব কি মনের পূর্ণতার ছায়া নয়?
সম্পূর্ণ একা একা যুগল ভ্রমণে ওরা যে পরিপূর্ণতার স্বাদ পেয়েছে, তা তো ওদের মসৃণ মুখে, গভীর চোখে, আর কথার মধ্যেকার নিবিড় ব্যঞ্জনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এই জন্যেই বোধ করি বুদ্ধিমানের দেশে হনিমুনের প্রথা। অনেকজনের মধ্যে, সমাজ-সংসারের আওতার মধ্যে দৃষ্টি থাকে অস্বচ্ছ, চিত্ত থাকে বন্ধনগ্রস্ত, ভালবাসা নিজেকে বিকশিত করবার জায়গা পায় না।
দিদিরা বৃন্দাবনের ছুতো করে হনিমুন ঘুরে এল, পরস্পরের মধ্যে ডুবল।
তবে আর আমি ওদের অবজ্ঞা ছাড়া কী করব?
অবজ্ঞা করে বললাম, ওরে বাস, দিদি কী সাংঘাতিক মুটিয়েছিস? যাই বলিস, বড় হ্যাংলা বাপু তুই। এই কদিনের মধ্যেই এত আদর খেলি যে, ডবল হয়ে গেলি?
ডবল অবশ্য হয়নি দিদি, তবু সেটাই বললাম ঘেন্না দিতে।
দিদি হাসল।
প্রতিবাদ করল না।
প্রতিবাদ করল দিদির বর।
বলে উঠল, এটা বড় বেশি অতিশয়োক্তি হচ্ছে না নমু?
আমি বললাম, মোটেই না। আপনি অন্ধ–চোখে দেখতে পাচ্ছেন না।
দিদি বলল, যা বলেছিস! শীতের মুখে নতুন দেশে বেড়াতে গিয়ে বেজায় চেঞ্জ লেগে গেছে।
পিসি যদি সহবত শিক্ষার পরাকাষ্ঠা দেখাতে নমিতাকে তার এক ঘণ্টার বড় বোন সুমিতাকে দিদি বলতে না শেখাত, যদি ওদের তো আর ছোট বড় নেই ভেবে বাঁচাল ছটফটে নমিতাটাকেই বর পাইয়ে দিত, আর সুমিতা যদি না আজীবন দিদিগিরির মাসুল জোগাত, হয়তো ওদের দুজনেরই জীবন-ইতিহাস আলাদা হত।
হয়তো ওরা আর পাঁচজনের মতোই সুখী সন্তুষ্ট গৃহিণী হত। কিন্তু তা হল না।
পিসি ওদের জীবনের প্রারম্ভে পরম শত্রুতা সেধে রেখেছিল।
কিন্তু শুধুই কি পিসি?
ভাগ্যদেবতা নয়?
ক্রুর নিষ্ঠুর দেবতা নামের কলঙ্ক ভাগ্য-বিধাতা!
নমিতার তো সুমিতার থেকে দামি পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হল কমাস পরেই। তবু কেন?
নমিতা পিসিকে যতই অবজ্ঞা করে আসুক আজীবন, পিসি তার কর্তব্যে ত্রুটি করেনি একতিলও। শুধু পিসি সুমিতার আগে নমিতার বিয়ে দেয়নি। কিন্তু সেই তো কাল হল, নমিতা তাই সুমিতার বরকে আগে দেখল। তাদের এই মরুভূমির সংসারে এক পশলা বৃষ্টি, এই হারেমের জীবনে একটি যুবক পুরুষ।
পিসি নির্বোধ হলে কী হবে, সাধারণ সংসার-পরিবেশের নীতি-দুর্নীতি, সভ্যতা-ভব্যতা, এসব তার চোখ এড়াত না। জামাইবাবুকে নিয়ে নমিতার মাতামাতি তার চোখ এড়ায়নি, আর জামাইকে ভালবাসলেও তার বেপরোয়া হুল্লোড় তার চোখে ভাল ঠেকত না।
তাই ওরা যখন বৃন্দাবনে গেছে, উঠেপড়ে লেগে পাত্র খুঁজেছে পিসি।
তা বাড়ি আর বর, এটা তখন অত দুর্লভ ছিল না। চেষ্টার মতো চেষ্টা করলে পাওয়া যেত।
অবস্থাপন্ন ঘরের এক উকিল পাত্র জোগাড় করে ফেলল পিসি। বছর দুই হল ল পাশ করে কোর্টে বেরোচ্ছে, সংসারে মা আছে, আরও দুটো ভাই আছে, কলকাতায় দুখানা বাড়ি আছে, দেশে জমিজমা আছে।
আর কী চাই?
জামাইয়ের চেহারা?
তাও ভাল।
বরং প্রিয়মাধবের থেকে আরও একটু ফরসা।
ওরা সংসার পাতাতে না পাতাতেই পিসি এই পাত্রের কথা বলল ওদের কাছে।
আহ্লাদে উছলে উঠল ওরা।
নমিতাও উছলোবেই প্রতিজ্ঞা করে ঝলসে বেড়াতে লাগল।
প্রিয়মাধব বলেছিল তখন, দুদিকে দুই চিনির নৈবিদ্যি নিয়ে বেড়াতে যাওয়া, বায়োস্কোপ যাওয়া, সবই বুঝি ঘুচল এবার, ফাউটা লুঠে নিতে ডাকাত পড়েছে।
নমিতা বলেছিল, দুদিক সামলাবার দায় থেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন তেমনি।
ওটা কি দায়?
তা একরকম।
প্রিয়মাধব বলেছিল, তা হোক, বুকের আধখানা খালি হয়ে যাচ্ছে। সুমিতার সামনেই বলেছিল।
সুমিতা বলেছিল, তোমার ইয়ার্কির ধরনটা এবার বদলাও বাপু! কে কী ধরনের লোক জানা তো নেই। ওর বর যদি এসব পছন্দ না করে?
না করে, উকিলের চিঠি দেবে।বলে হেসে উঠেছিল প্রিয়মাধব।
প্রিয়মাধব নামের ওই লোকটাকে নমিতা তখন কিছুতেই ঠিক বুঝতে পারত না। কখনও মনে হত, সুমিতা নামের ওই নিস্তেজ শান্ত মাতৃপ্রকৃতির মেয়েটার মধ্যে সে তার চঞ্চল রক্তের পরিতৃপ্তি পায় না। তাই নমিতার আগুনের দিকে আকৃষ্ট হয়, তার মধ্যে মনের চাহিদা মেটায়।
কখনও মনে হত, ওই সুমিতা-সাগরের অগাধ গভীরতাতেই সে নিমজ্জিত, এই চপলতা তার আমোদ মাত্র।
অতএব নমিতা অপমানিতা।
এই দুই টানাপোড়েনের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল নমিতার।
নমিতা মনে করল ওদের একবার দেখিয়ে দিতে হবে।
দেখিয়ে দিতে হবে প্রেম কাকে বলে, প্রেমের উচ্ছ্বাস কাকে বলে।
মনে করল।
যদি সেই ওর মনে করাটা কাজে করতে পেত, তা হলেও হয়তো সবই ঠিক থাকত, কিন্তু নমিতা অনেক পেয়েও কিছু পেল না।
হেমন্ত উকিলের বহুবিধ গুণের মধ্যে একটা বিশেষ গুণ ছিল। চপলতা সে আদৌ পছন্দ করত না।
থিয়েটার বায়োস্কোপ দেখাকে সে অসার-আমোদ বলে মনে করত, নাটক নভেল পড়াকে প্রায় দুর্নীতি বলে মনে করত, এবং কবিতা বস্তুটা যে মানুষ ইচ্ছে করে পড়তে পারে, এটা সে ভাবতেই পারত না। তবে স্ত্রীকে সে ভালবাসতে দেরি করেনি। এবং স্ত্রীর এক ঘণ্টার দিদিকে দিদি বলে সমীহ করতেও ত্রুটি করেনি।