আমি অতঃপর বাবার বইয়ের আলমারির চাবি খুলতাম।
এ ছাড়া অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে এখানে বসিয়ে রাখবার যুক্তিই বা কী? শুধু দুজনে গল্প?
বেশিক্ষণ জমে না।
কথা খুঁজে পাওয়া যায় না।
অথচ দিদি যতক্ষণ থাকে দুজনেরই মুখে খই ফোটে।
জামাইবাবু বলত, তোমার বাবার এই বইয়ের আলমারিগুলো দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। ভদ্রলোক হয়তো সব পড়েও যেতে পারেননি।
আমি আবহাওয়া গম্ভীর করতে রাজি হতাম না। বলতাম, তা পৃথিবীর নিয়মই এই, ধনবানে কেনে বই, জ্ঞানবানে পড়ে।
তবে পড়ুন জ্ঞানবতী মহিলা!
আমি দু-একখানা বই নিয়ে পাতা ওলটাবার ভান করতাম। অথচ আমি জানতাম কী পড়ব আমি। প্রেমের কবিতাই বেছে বেছে পড়তাম।
একদিন নারীর উক্তি পড়ছিলাম চয়নিকা থেকে। লজ্জার বালাই রাখিনি আমি, বেশ খোলা গলায় পড়েছিলাম–
আমি কি চেয়েছি পায়ে ধরে,
ওই তব আঁখি তুলে চাওয়া,
ওই কথা, ওই হাসি, ওই কাছে।
আসা-আসি।
অলক দুলায়ে দিয়ে হেসে চলে
যাওয়া?
কেন আন বসন্তনিশীথে আঁখিভরা আবেশ বিহ্বল—
হঠাৎ দিদি দোতলায় এল। এমন আসে না কোনওদিন।
আমার সহসা মনে হল দিদি আমাদের উপর আচমকা ইনস্পেকশন চালাতে এসেছে। কেঁপে উঠলাম যেন। নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হল। তাড়াতাড়ি বললাম, এই দেখ দিদি, তোর হয়ে নারীর উক্তি শুনিয়ে দিচ্ছি জামাইবাবুকে।
দিদি একটা ড্রয়ার খুলছিল। অবাক হয়ে বলল, কী বলছিস?
বলছি তোর কথাটা আমিই শোনাচ্ছি
দিদি হেসে বলল, আমার আবার কথা কি?
তোর কোনও কথা নেই?
কই, মনে পড়ছে না তো!
আমি সামলে উঠলাম। বললাম, তবে এসেছিলি কী করতে মরতে রসভঙ্গ করতে?
দিদি হেসে বলল, তোদের রসভঙ্গ করি, এ উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি বাপু। পিসিমা নিমকি কাটবার জন্যে একটা পাতলা ছুরি চাইলেন–
ড্রয়ার থেকে পাতলা ছুরিখানা নিয়ে চলে গেল দিদি তাড়াতাড়ি।
জামাইবাবু চেঁচিয়ে বললেন, ওহে মহিলা, ছুরিখানি এই হতভাগ্যের বক্ষে বিদ্ধ করে গেলেই ভাল হত না?
দিদি একটু দাঁড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে হেসে বলে গেল, তোমাদের জমজমাটি আসরের উপর তো ছুরিকাঘাত করেই গেলাম!
আমি বই মুড়ে ফেললাম।
দিদি চলে যাবার পর সত্যিই আর পাঠ জমল না।
আমি বইটা ঠেলে রেখে বলে ফেললাম, ছুরিটা ছুতো।
জামাইবাবু চমকে বললেন, কী বললে?
বলছি, দিদি ছুরির ছলে আমাদের উপর চোখ ফেলতে এসেছিল।
এরকম কথা আমি কোনওদিন বলিনি।
সেদিন ইচ্ছে করে বললাম।
আমি যেন কিছু একটা উদঘাটিত করতে চাইছিলাম। এই ধরনের প্রসঙ্গ এনে ফেলে ভয়ংকর খাদের পথে পা বাড়াতে চাইছিলাম।
কিন্তু জামাইবাবু যেন আমার গালে একটা চড় মারল।
জামাইবাবু বলল, তোমার দিদি স্বর্গের দেবী নমিতা! ও জিনিস ও ভাবতেই পারে না।
ঘরে এসে সত্যিই নিজের গালে নিজে চড় মারলাম আমি। আর ভাবলাম আর নয়, আর নয়।
কিন্তু ওর সঙ্গে কথা না কয়ে থাকতে পারি না কেন?
.
সর্বদা ওর আশেপাশেই ঘুরতে ইচ্ছে করে কেন?
একদিন পিসি বলেছিল, হ্যাঁ রে নমি, তুই সর্বদা প্রিয়মাধবের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিস কেন বল তো? বড় হয়েছিস!
আমি কড়া গলায় বললাম, কেন, সন্দেহ হচ্ছে খারাপ হয়ে যাব?
পিসি থতমত খেল।
বলল, বাবাঃ, যেন ফণাধরা কেউটে! তোর সঙ্গে কথায় কে পারবে!
পিসে বলল, আর এ-ও বলি, নতুন জামাই এতদিন শ্বশুরবাড়িতে কেন?
পিসি আবার তৎক্ষণাৎ ফণাধরা কেউটের মতো ফোঁস করে উঠল।
বলল, আছে, বাড়িটা ওর শ্বশুরের বলে। পিসেশ্বশুরের বাড়ি হলে থাকতে আসত না। ও ভদ্দর ছেলে, তাই আলাদা বাসা খুঁজছে, নইলে ইচ্ছে করলেই তো এখানে থাকতে পারত।
থাকতে পারত? পিসে ভ্যাবলার মতো বলল, চমৎকার।
পিসি বলল, অবাক হচ্ছ কেন? পারতই তো, সুমির আর নমিরই বাড়ি, মনে রেখো সেটা।
পিসের কাছে কোনও সময় হারবে না পিসি, তা নিজের স্বার্থে ঘা পড়লেও। অথচ একদিনের জন্যে ছাড়াছাড়ি থাকতে পারে না দুজনে।
পিসি একটু গঙ্গা নাইতে গেলে, যতক্ষণ না ফেরে, ছটফট করে পিসে।
.
তা এইসবের পরের দিনই বৃন্দাবনে গেল ওরা।
দেদার কাঁদল দিদি।
আর আমার মনে হল, কান্নাটা দিদির ছল।
ও যেন আমাকে দুয়ো দিয়ে সেজেগুজে বরের সঙ্গে গাড়িতে উঠল।
জামাইবাবুর মুখে কী প্রসন্নতা!
তার মানে, আমাকে নিয়ে ওর শুধু মজা। আমি ওর খুশির খেলনা, ওর কৌতুকপ্রিয় প্রকৃতির কৌতুকের একটা উপকরণ। দিদিই প্রাণপুতুল। হ্যাঁ, এ কথা আমায় বলেছিল জামাইবাবু, বলেছিল দিদিকে দেখতে এসে দিদির শান্তশিষ্টনমূর্তি ওর মনে কোনও দাগ বসাতে পারেনি। পরে আমার চপলতাতেই আকৃষ্ট হয়েছিল, এবং এক কথায় কথা দিয়ে গিয়েছিল। তবে এও বলেছিল, কিন্তু পরে দেখলাম, ঘটনাটা ওভাবে না ঘটলে ঠকতুম। তোমার দিদি একটুকরো খাঁটি সোনা।
সেই খাঁটি সোনাটি নিয়ে খাঁটি বোষ্টম মা বাপের কাছে দর্শন দিতে গেলেন প্রিয়মাধববাবু, মাস্টারমশাই ছলছল চোখে ওদের মোটঘাট গাড়িতে তুলিয়ে দিল।
হয়তো মাস্টারটিকে নিয়ে খেলতে পারতাম। দিদিকে মুছে ফেলতে পারতাম ওর মন থেকে, কিন্তু সেটা বড়ই অরুচির।
এই প্রথম নিঃসঙ্গতা অনুভব করলাম জীবনে। আর দিদির স্নেহ, দিদির একান্ত ভালবাসা মনে পড়ে হৃদয় দীর্ণ-বিদীর্ণ হতে লাগল, নিজের প্রতি ধিক্কার এল। পিসির কাজের সাহায্য করতে শুরু করলাম।
.
কিন্তু সেই শ্মশান-বৈরাগ্য আর কদিন?
দিদিরা ফিরল।
ওদের তখন বাসা ঠিক হয়ে গেছে। মাস্টারমশাই জোগাড় করে রেখেছে। আর পিসি মাস্টারের সঙ্গে গিয়ে উনুন পেতে, ভাঁড়ার গুছিয়ে রেখে এসেছে। দিদির যে বাবার বাড়ির ভাগের কথা মনে পড়েনি, এই কৃতজ্ঞতায় অনেকটা করছে পিসি।