জামাইকে যে পিসি যথার্থ জামাই-আদর করছে সে গল্প করার জন্যেও আরও এত যত্ন পিসির।
পিসি নীচের তলায় সারাক্ষণ, আমরা দোতলায়। জামাইবাবু বিয়ে বাবদ যে ছুটি নিয়েছিল তার জের চলছিল, তাই সর্বদাই আছে বাড়িতে।
জামাইবাবু বলত, যদি সেকাল হত, এবং আমি একজন রাজা হতাম, তোমাদের দুজনকেই রানি করে ফেলতাম।
দিদি ইতিমধ্যেই ওর বরে একেবারে নিমগ্ন হয়ে গিয়েছিল। বরকে দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে যেত, কিন্তু কথা বেশি বলতে পারত না। ও রকম কথায় বড়জোর বলত, তা হলে অবশ্যই একজন দুয়োরানি হত, আর আমারই দুয়োরানি হবার চান্স থাকত বেশি।
জামাইবাবু হেসে উঠে বলত, কেন? হঠাৎ এহেন সন্দেহের হেতু?
বাঃ, আমি যে বড়। বড়রানিরাই তো দুয়োরানি হয়।
দিদি কি তার অসতর্ক উক্তিকে ওইভাবে আবার ঢেকে নিত? না দিদির সরল বিশ্বাসী মন ওই ভাবেই ভাবত?
জামাইবাবু ও কথা হেসে ওড়াত। আচমকা আমাদের দুজনকে দুহাতে জাপটে ধরে বলে উঠত, আমার কাছে দুয়োর পাট নেই। দুজনেই সুয়ো৷ ২৬২
কৌতুকছলে হলেও ওই নিবিড় পুরুষ-স্পর্শ নিথর করে দিত আমাকে। মনে হত এই মুহূর্তটুকু চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে থাক, ডুবে যাক বিশ্ব চরাচর। কিন্তু সেই মনে হওয়াটাকে সবলে বিসর্জন দিয়ে হাত পা ছুঁড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলতাম, দিদি না হয় আপনার বউ, যা ইচ্ছে করতে পারেন। আমায় কেন?
জামাইবাবু বলত, দিদি বউ, তুমি মৌ। আরও মিষ্টি।
আমি অবাক হয়ে ভেবেছি, দিদি কেন রাগ করত না। আমি হলে নির্ঘাত রেগে-জ্বলে কুরুক্ষেত্র করতাম। দিদি কি এত বেশি পেয়ে গিয়েছিল যে, ওই উপচে পড়া ফেনাটুকুতে দৃকপাত করত না? না কি এ ওর সেই ছেলেবেলার মনোভাব। একটা খেলনা কি একটা পুতুল পেলে যেমন বিনা দ্বিধায় আমাকেই সেটা দিয়ে দিত দিদি, এও তাই?
তা সত্যি বলতে, রাতটুকু বাদ দিলে দিনের সময়ের অধিকাংশ আমিই দখল করে রাখতাম জামাইবাবুকে। গল্পে তর্কে গানে আবৃত্তিতে আমাদের দুজনের জমজমাটি আসরে দিদি যেন দর্শকমাত্র, শ্রোতামাত্র। অথচ দিদির মুখ আহ্লাদে জ্বলজ্বল করত, দিদির চোখ খুশিতে উদ্ভাসিত থাকত।
এটাও আমার কাছে অপমানকর ছিল বইকী!
এতে যেন দিদি আমার স্তর থেকে অনেকটা উচ্চস্তরে উঠে যেত। মনে হত দিদি তার অগাধ ঐশ্বর্যের এক কণা আমায় উপহার দিয়ে আত্মতৃপ্তির সুখ উপভোগ করছে।
আর রাত্রে যখন দিদি আস্তে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে নিঃশব্দে খিলটা লাগিয়ে দিত, আমি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সেই দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবতাম, কাল থেকে আর দিদির ওই কৃপার উপহারটুকু নিয়ে কৃতার্থ হব না আমি। জামাইবাবুকে অবজ্ঞা করব অগ্রাহ্য করব, কথার উত্তরে উছলে উঠব না। নিজের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকব। বহুক্ষণ ঘুম আসত না, ওই প্রতিজ্ঞাটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতাম, দেখতে চেষ্টা করতাম তার প্রতিক্রিয়া।
কিন্তু সকাল হতেই যেই জামাইবাবু তার দীর্ঘ বলিষ্ঠ অপরূপ আকর্ষণীয় চেহারাটি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই বলে উঠত, শালির নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে? তখন চুপ করে থাকতে পারতাম না। উছলে উঠেই বলে উঠতাম, হবে না কেন? আমার তোে অর্ধরাত অবধি জাগরণের পালা ছিল না।
জামাইবাবু হেসে উঠে বলত, নাঃ, একটা ভায়রাভাই জোগাড় করে না ফেলা পর্যন্ত শান্তি নেই।
তীক্ষ্ণ হতাম আমি, আপনার অশান্তিটা কী?
বাঃ, নেই? একজন তৃষিতের সামনে বসে শীতল পানীয় পান করায় বিবেকের একটা দংশন নেই? আবার কথায় কথা বাড়ত, তর্ক জমত, ঝগড়া রাগারাগি সব কিছুর পালা চলত। সকালবেলাটা একছত্র অধিকার থাকত আমার। কারণ, দিদি সে সময়টা কিছুতেই দোতলায় বসে থাকত না, পিসির সাহায্যার্থে নীচে নেমে যেত, রান্নাঘরে বসে থাকত।
রেগে বলতাম, দিদি, পিসি তো একাই একশো! তুই আর সমুদ্রে শিশির বিন্দু ঢালতে যাস কী জন্যে?
দিদি বলত, তা হোক, শিশির বিন্দুরও একটা কর্তব্য আছে।
সে কর্তব্য এ ভদ্রলোকের উপরও থাকা উচিত। পিসির কাছে দু ঘণ্টা বসে থেকে তুই হয়তো পিসির দুটি শাক বেছে দিবি, কি চারটি কড়াইশুটি ছাড়িয়ে দিবি, কী বা লাভ হবে তাতে পিসির? অথচ এখানে তুই থাকা মানেই জামাইবাবুকে শীতলতার সাগরে ডুবিয়ে রাখা!
এখানে তো তুই আছিস, দিদি হেসে উঠত। বলত, তুইও একাই একশো!
রেগে বলতাম, অত বিশ্বাস করিসনি দিদি, ইচ্ছে করলে তোর বরকে কেড়ে নিতে পারি তা জানিস?
দিদি সেই অদ্ভুত মিষ্টি হাসিটা হাসত তখন। বলত, যে জিনিস কেউ ইচ্ছে করলে কেড়ে নিতে পারে, সে জিনিস থাকা না থাকায় তফাত?
চমৎকার! তোর গায়ের গয়নাগুলো রাস্তায় ফেলে রাখ তা হলে?
তা কেন? ওগুলো তো জড়বস্তু। ওর কি নিজস্ব সত্তা আছে?
ওসব পণ্ডিতি কথা রাখ। কখন কী হয় কে বলতে পারে?
তা না হয় পারে না,–দিদি হাসত, তোরই বা হঠাৎ অন্যের বর কেড়ে নেবার ইচ্ছে হবে কেন? তুই কি যে-সে?
আমি সামলে নিতাম নিজেকে।
ব্যাপারটাকে স্রেফ তরল ঠাট্টার খাতে গড়িয়ে দিতাম। বলতাম, তা হাতের কাছে নিজের বর পাচ্ছি না যখন।
ওরা দুজনেই হেসে উঠত।
রাতারাতি ওর একটা বর জোগাড় করো দিকি, বলে দিদি বরের দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে চলে যেত।
আমি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতাম, সেই যাচ্ছিস তো শাক বাছতে? মরগে যা! আমরা এখন রবীন্দ্রকাব্য-পাঠ সভা বসাচ্ছি।
দিদি অনুচ্চ পরিষ্কার গলায় উত্তর দিয়ে যেত, বসাস ক্ষতি নেই, বেশি গলা খুলিসনে। পিসেমশাইয়ের কানে না পৌঁছলেই ভাল।