দিদি বাসরে কথা বলেনি, আমিই চালিয়ে গেছি আলাপ।
বললাম, গোলকধাঁধায় পড়েও তো ভয় খেয়ে পালালেন না, সম্মতি দিয়ে গেলেন।
বর বলল, ভয় বস্তুটা নেই আমার। বরং ভয়ের প্রতিই আকর্ষণ।
তবু ঠকেছেন, এটা মানছেন তো?
বর হেসে বলল, উঁহু, মানছিনা। রীতিমত লাভবানই হয়েছি। একটির বদলে দুটি পেলাম, স্ত্রীর সঙ্গে শালি! ফাউ জিনিসটা লোভনীয়। তা ছাড়া শাস্ত্রে বলেছে, শান্ত স্ত্রী আর মুখরা শালি এটাই পরম সুখের।
এ শাস্ত্র কে আপনাকে শেখাল শুনি?
সব শাস্ত্র শিক্ষা করতে হয় না, কিছু শাস্ত্র বাতাসে ফেরে। ধরো প্রেমশাস্ত্র।
রাগ দেখিয়ে বললাম, ও শাস্ত্রটা বেশ ভালমতো শিখে ফেলেছেন বুঝি আগে থেকেই?
দিদি আমায় চিমটি কেটে থামাল।
এইভাবে দিদির বাসর কাটল।
বিয়ের কদিন পর দিদিকে নিয়ে জামাইবাবু তার মা বাপকে দেখাতে বৃন্দাবন যাবার ঠিক করল।
আমার মনে হল দিব্যি একখানা হনিমুন বাগাল দিদি! আর একবার ঈর্ষা অনুভব করলাম। অথচ জীবনে এই প্রথম দিদির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার মুহূর্তে ভয়ানক একটা মন-কেমনের যন্ত্রণা বোধ করতে লাগলাম। দিদি তো কেঁদে কেঁদে মুখ ফুলিয়েই ফেলল। একবার পিসির কাছে আবেদন করেছিল দিদি আমায় নিয়ে যাবার জন্যে, কিন্তু পিসি মারতে এল। বলল, এমন কথা বাবার কালে শুনিনি। তুই যাচ্ছিস তোর বরের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি, ও অত বড় মেয়ে তোর সঙ্গে যাবে কোন সুবাদে?
আমার যাওয়া হল না।
জীবনে এই প্রথম দিদির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হল আমার। বিয়ের পর এ কদিন দিদি তো প্রায় আমাদের বাড়িতেই ছিল, সঙ্গে জামাইবাবুও। কারণ ওর কাকার বাড়িতে আলাদা ঘর নেই।
মাস্টারমশাইকে একখানা বাসা খুঁজে রাখবার অনুরোধ জানিয়ে জামাইবাবুরা গাড়িতে উঠল।
দিদি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আমায় দেখছিল, আর কাঁদছিল, আমারও চোখ শুকনো ছিল না। তবু যেই ওদের গাড়ি বেরিয়ে গেল, আমার মনে হল, দিদির ওটা লোক-দেখানো ন্যাকামি। যাচ্ছেন বরের সঙ্গে নাচতে নাচতে রেলগাড়ি চড়ে বেড়াতে, শুনছি নাকি ফেরার সময় দিল্লি-আগ্রা দেখে আসবে, এর মাঝখানে কিনা বোনের জন্যে অশ্রু বিসর্জন করছেন! সব বাজে। দেখানো- দেখো দেখো, আমি কত মহৎ, কত ভাল! দিদির প্রতি এই এক অদ্ভুত ভাব ছিল আমার। প্রবল ভালবাসা, অথচ তীব্র ঈর্ষা। আমার এই মনস্তত্ত্বের তত্ত্ব বুঝতে পারিনি আমি কোনও দিন।
একাধারে দিদি আমায় টেনেছে আর ঠেলেছে।
এ কি আমরা যমজ বলে?
কিন্তু দিদির ক্ষেত্রেও তো তা হলে একই হবে।
অথচ তা হয় না।
দিদি আমার প্রতি স্নেহে বিগলিত। দিদিও যদি আমাকে হিংসে করত, হয়তো ভাল হত আমার। সর্বদা দিদিকে উচ্চস্তরের আর নিজেকে নিম্নস্তরের ভাবার গ্লানি এমন রূঢ় যন্ত্রণা দিত না আমায়।
.
দিদি হিংসের কথা ভাবতেই পারে না।
আর কেনই বা করবে?
দিদি তো অবিরত জিতেই চলেছে। আমার সব কর্মে পটুত্ব এবং দিদির সব বিষয়ে অপটুত্ব থাকা সত্ত্বেও চিরদিন পিসি থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি সবাই দিদিকে প্রশংসা করেছে, দিদিকে বেশি ভালবেসেছে।
কারণ?
কারণ দিদি শান্ত, দিদি নম্র, দিদি সকলের মনজোগানী।
ওইগুলো যে দিদির সহজাত, এটা যেন সব সময় বিশ্বাস হত না আমার, মনে হত সুখ্যাতির আশায় ও রকম নরম হয়ে থাকে দিদি। কিন্তু ভাবলে আর কি, জিতে তো যেত দিদি।
পরীক্ষাতেও দিদিই জিতল।
রাতদিন বই নিয়ে বসে থেকে থেকে সিদ্ধিলাভ করল। ওটা আমার অসহ্য। তা ছাড়া আমি ভেবেছিলাম দু-পাঁচদিন পড়েই মেরে নেব আমি, দিদির সারা বছরের খাটুনির ফসলের থেকে, ওই পাঁচদিনের খাটুনিতেই ভাল ফসল ঘরে তুলব। হল না।
মাস্টারমশাইয়ের মতো নির্বোধ একটা বুড়োর বিহ্বল দৃষ্টি আমার কাছে হাস্যকর, তবু দিদির প্রতি ওঁর ওই দৃষ্টি আমাকে বেজার করত।
তারপর তো বিয়ে হয়ে জিতে গেল দিদি।
ওর মনের মধ্যে বিয়ের জন্যে চাহিদার সৃষ্টি হয়নি, তবু দিব্যি একখানা বর পেয়ে গেল ও। এক ঘণ্টার বড়র দাবিতে এই পাওয়া যেন নির্লজ্জতার মতো মনে হল আমার।
তাও বরটা কেন বোকা-হাঁদা বুদ্ধ হল না? কেন কালোকোলো মোটা বেঁটে হল না?
না, দিদির প্রতি শত্রুতার মনোভাব নিয়ে এ কথা বলছিনা আমি। শুধু বলছিলাম দিদি যা মেয়ে, যে কোনও রকম বরকেই মেনে নিত ও। ওর লোকসান হত না কিছু।
তাই ভেবেছি তখন।
ভেবেছি দিদিকে আমি পুরোপুরি পাঠ করে ফেলেছি, এবং বুঝে নিয়েছি, সব রকম অবস্থাকে মেনে নিতে পারত ও
কত ভুলই ভাবি আমরা মানুষের সম্পর্কে!
দিদির বিয়েটা আমার কাছে কিঞ্চিৎ জ্বালাস্বরূপ হলেও, উন্মাদনা-আমোদও ছিল বইকী! বিয়ের বারো-চোদ্দ দিন তো এখানেই প্রায় থেকেছে ওরা। পিসির সংসারের এই স্তিমিত ছন্দের উপর এ যেন একটা উত্তাল ঝড়, অন্ধকার অন্তঃপুরে আলোর বন্যা।
সর্বদা এক স্ফুর্তিবাজ এবং প্রায় বেপরোয়া যুবকপুরুষের সান্নিধ্য আমাকে যেন নেশাচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
জামাইবাবুর ওই বেপরোয়া ভঙ্গি অবশ্য পিসি ততটা দেখতে পেত না; পিসি জামাই-আদরের রসদ গোছাতেই ব্যস্ত থাকত।
আর পিসিরও মেয়েলি মনের জামাই বুভুক্ষা পরিতৃপ্ত হচ্ছিল। তা ছাড়া লোকের কাছে তো গল্প করতে হবে পিসিকে। পিসির এক মাসতুতো বোন আসত প্রায়ই, পিসির প্রাণের পুতুল। তাকে সব বলা চাই। আর বেশি করেই বলা চাই।