মাস্টারমশাই জলখাবার প্লেট নিয়ে এলেন, আমি চা।
ওরা অবশ্যই এমন দেখেনি।
কেই বা দেখেছে, ঘাড় হেঁট করে কনে দেখা দেখিয়ে, সে মেয়ে তক্ষুনি বীরদর্পে আবার এসে ঘরে ঢোকে আতিথ্য করতে!
অতএব ওরা প্রায় হোঁচট খেল।
বন্ধুটি বলল, আঃ, আপনি আবার কেন কষ্ট করে—
আমি তো প্রস্তুত হয়েই গেছি।
চটপট উত্তর দিলাম, তাতে কী? আপনারা এত কষ্ট করে সেই কতদূর থেকে এসেছেন।
বর চমকে তাকাল।
তারপর মৃদু হেসে বলল, আপনার পিসেমশাইকে খুব ভয় করেন, তাই না?
মাস্টারমশাই একটু তাড়াতাড়ি বললেন, তা করে।
বোঝাই যাচ্ছে, ঠকেছে। তবু সেটা আরও দৃঢ় করলেন মাস্টারমশাই। পিসের উপস্থিতির জন্যেই যে তখন এগজামিনে কোন সাবজেক্ট ছিল তাই বলতেই গলা বসে যাচ্ছিল, এবং তাঁর অনুপস্থিতিতেই গলা খুলল, সেটা ধরে নিয়ে বরই বলে বসল, পিসেমশাইকে খুব ভয় করেন বুঝি?
মাস্টারমশাই বললেন, তা করে।
বর আবার বলল, আমি তো তখন সত্যি বলতে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম। ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করা মেয়ে, অথচ নাম জিজ্ঞেস করলে ঘাম ছোটে–
আমি খোলা গলায় বললাম, কে বললে ফাস্ট ডিভিশন? মোটেই না। ওটা মাস্টারমশাইয়ের চালাকি। আমি মোটেই ফার্স্ট ডিভিশন নই।
ওরা অবশ্য ঠাট্টা ভাবল।
আবার বলল, যাক ওটা না হলেও ক্ষতি নেই, আপাতত তো লেটার পেয়ে পাস।
আমিও আবার বললাম, পাস-ফেলের ব্যাপার তো মিটে গেছে আগে। এখন আর এটা পরীক্ষার হল নয়, আর আমিও পরীক্ষার্থী নই, এসেছি আতিথ্য করতে। খাবারগুলো গরম আছে, ঠাণ্ডা করবেন না।
বন্ধুটি বলে উঠল, এখন আর ওঁর ঠাণ্ডা-গরমে কোনও প্রভেদ নেই।
বাচালতা করব স্থির করেই গেছি, বিয়েটা পণ্ড হলেই যেন মঙ্গল, এই মনোভাব, মাস্টারমশাইও তার সমর্থক। কাজেই বলে উঠলাম, হঠাৎ অবস্থা এমন শোচনীয় হল যে? শীত-গ্রীষ্ম, শীতল-উষ্ণে প্রভেদ নেই।
অবস্থা শোচনীয় হবার জন্যে আপনিই দায়ী,বললে বর, তখন যেন উৎসাহে বরফ জল ঢাললেন, আর এখন
এখন গরম জল, চা। বললাম হেসে হেসে, তা ছাড়া পিসিমা আরও এক থালা পুলি গড়ে নিয়ে ভাজছেন, আপনাদের গরম খাওয়াবেন বলে।
বন্ধুটি বলে উঠল, ইস। বিয়ে কাজটা আগেই ঘটিয়ে বসে আছি বলে আফশোস হচ্ছে। এ বাড়ির জামাই হলে, অন্তত গরম গরম পিঠে-পুলিটা জুটত ভাল৷
আমি বললাম, তা আফশোস জিনিসটা কি ফুরিয়ে যাবার? হয়তো ওটা আপনার বন্ধুর ভাগ্যে তোলা থাকল। বাকি জীবনটা উনিই করতে পারবেন ওটা।
ঠাট্টা জিনিসটাও নাকি ভয়ংকর।
প্রতিকূল গ্রহনক্ষত্ররা নাকি অদৃশ্যলোকে বসে মানুষের উচ্চারিত শব্দের উপর তথাস্তু করে। বলে, ঠিক আছে, যা বলেছিস তাই হবে। তথাস্তু।
হয়তো আমার সেই ঠাট্টার সময় ওই তথাস্তু গ্রহ বসেছিল।
কিন্তু তখন তাকে দেখা গেল না।
তখন মনে হল সমস্ত গ্রহই অনুকূল।
.
পিসি আহ্লাদের সাগরে ভাসছিল। পিসে আসতেই বলে উঠল, কথা দিয়ে গেল।
পিসেমশাই বললেন, যাবে না মানে? শালার মেয়েরা কি ফেলনা? বলি খাঁই-টাই কী রকম বুঝলে?
পিসি বলল, শোনো কথা। খাঁইয়ের তো নামগন্ধ নেই। মা বাপ দেখবে না, ছেলে কি নিজে খাঁই করতে বসবে? কিছু নেবে না।
পিসে বলল, নেবে মানে? কত বড় কুলিনের ঘরে বিয়ে করতে ঢুকবে, তা জানো?
পিসি বলল, জানব না কেন? তুমি যত বড় ঘরে ঢুকেছিলে!
রেগে বলল না, হেসে।
বাড়িতে হালকা-হাসির হাওয়া উঠছে। মাস্টারমশাইও চলে গেছেন হাসি দেখিয়েই। দেখিয়েছেন পিসিকে।
আমিও দেখাচ্ছি হাসি। হি হি করে হেসে হেসে বলছি, কীরে দিদি, লাগল কেমন?
দিদি বলল, আমার থেকে তুই বেশিক্ষণ দেখেছিস, তুই-ই বল।
আমার বলায় লাভ? বেল পাকলে কাকের কী?
দিদি হঠাৎ একটা খাঁটি কথা বলল। হঠাৎ এই রকম এক-একটা খাঁটি কথা বলে ফেলত দিদি। অবাক লাগত। মনে হত দিদি কি সত্যি বোকা? না ওটা ওর ছলনা?
দিদি বলল, তা বটে, তবে কাক বেচারিই বেলটা পাকাল এই যা দুঃখ।
তার মানে?
মানে, তুই গিয়ে খই না ফোঁটালে, পাত্র পত্রপাঠ প্রস্থান করত।
যে কথা আমি ভাবছিলাম, সেই কথা দিদি বলল।
আমাকে অতএব বিনয় করতে হল।
বললাম, তোর বুঝি বিশ্বাস ওরা ধরতে পারেনি? মাথা খারাপ! মাস্টারমশাই বলেননি ভেবেছিস? ও বাবা ফাস্ট ডিভিশনেই মোহিত।
দিদি শুধু একটু হাসল। অবিশ্বাসের হাসি।
বললাম, বাজি ফেল। বল ও ধরতে পেরেছে, না আমাকেই তুই ভেবেছে?
দিদি বলল, বাজিটার হারজিত প্রমাণ হবে কী করে?
জিজ্ঞেস করে জেনে নেব।
জিজ্ঞেস করে জেনে নিবি? কাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিবি তুই? বিমূঢ়ের মতো বলল দিদি।
কেন, তোর ভাবী বরকে? আমি একটা চিঠি লিখলে রাগ হবে তোর? দিদি আমার হাত চেপে ধরল। বলল, বাজে বাজে পাগলামি করিসনে নমু! কোথায় কী তার ঠিক নেই, রাস্তার একটা লোককে তুই চিঠি লিখতে যাবি? বাজিতে আমিই হারছি বাবা! হল তো?
এই স্বভাব দিদির।
যুদ্ধের আগেই হার মানা।
তখন ভাবতাম দিদিটা ভীরু।
এখন অন্য কথা ভাবি। ভাবি, জেতার জন্যে লড়ালড়ি না করে হার মানার খাতায় নাম লেখানো শক্তিহীনতার চিহ্ন, না শক্তির চিহ্ন?
দিদির মধ্যে যে শক্তি ছিল, সেটা এতই সহজভাবে সংহত ছিল যে, দেখতে পাওয়া যেত না। সেটা যেন সমুদ্রের মতো গভীর। আমি যে শক্তির বড়াই করেছি, সেটা সমুদ্রের উপরের ঢেউ।
দিদি বাজিতে হার মানার খাতায় স্বাক্ষর দিয়েছিল, কিন্তু দিদিই জিতল।
বাসরে বসে বর স্বীকার করল, সে আমাকেই দিদি ভেবেছিল, এবং দুবার দুরকম প্রকৃতি দেখে গোলকধাঁধায় ঘুরে মরেছিল, তবু ভাবতে পারেনি একজোড়া শাড়ির মতো অবিকল একজোড়া মেয়ে আছে এদের বাড়িতে।