দিদি খপ করে বলে বসত–তোর যেন সেই রাম না হতেই রামায়ণ।
রেগে বই মুড়ে বইয়ের কোনাটা ওর মাথায় ঠুকে দিয়ে বলতাম, ওরে মুখ, রাম না হতেই তো রামায়ণ। ঠাকুর এলে বসিয়ে রেখে তবে কি কোথায় চাল কোথায় কলা করে খুঁজে বেড়াতে হয়? আগে থেকে নৈবিদ্যি প্রস্তুত রাখতে হয়।
দিদি মিষ্টি করে হাসত।
দিদির মুখটা তখন একটু বুদ্ধি বুদ্ধি দেখাত। ওই মুখটাই যে আরশিতে দেখি আমি, তা মনে হত না।
দিদি বলত, রাখ প্রস্তুত করে। তারপর অসাবধানে কোন ফাঁকে কুকুর-শেয়ালে মুখ দিয়ে যাক।
ওরে সর্বনাশ! আমি লাফিয়ে উঠে বলতাম, এই ভয়ে তুই মনের দরজায় তালা-চাবি লাগিয়ে বসে আছিস? যৌবনকে রুপোর কাঠি ছুঁইয়ে রেখে দিয়েছিস?
দিদি বলত, ভারী অসভ্য হয়ে যাচ্ছিস তুই।
তা হয়তো সত্যি।
আমাদের আমলের সভ্যতা ভব্যতার মাপকাঠিতে আমি হয়তো একটু অসভ্যই ছিলাম। শান্ত মিনমিনে ভাল মেয়ে জীবটা আমার অসহ্য ছিল বলেই হয়তো এই অসভ্যতা।
তা ছাড়া পিসির সংসারের ওই ছকে বাঁধা স্তিমিত ছন্দে আমাকে যেন আর আঁটছিল না। আমার জীবন-তরণী সাগরে ভাসাবার উদ্দাম আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করছিল।…
কিন্তু আমি পিছিয়ে পড়লাম।
সাগরের টিকিট আমার জুটল না চট করে। এক ঘণ্টার সিনিয়রিটির দাবিতে দিদি সে টিকিট পেয়ে গেল, বিনা তদ্বিরে, বিনা আকুলতায়।
দিদিকে অবজ্ঞাই করে এসেছি চিরকাল, এই প্রথম হিংসে করলাম।
কিন্তু শুধুই করলাম?
না, করতে শুরু করলাম?
প্রফুল্ল মাস্টারই এনেছিলেন সুপাত্রের সন্ধান। কিন্তু একজোড়া নয়, একটা।
পিসি বলল, আমি তো দুটোকেই এক রাত্তিরে পার করতে চাই বাবা প্রফুল্ল।
মাস্টারমশাই বললেন, চাই বললেই কি সব সময় পাওয়া যায় মা? এটিকে বসিয়ে রেখে অন্য পাত্র খুঁজতে গেলে, এরা কি বসে থাকবে? অন্যত্র বিয়ে দিয়ে ফেলবে ছেলের।… একজনেরই লাগিয়ে দিন। একই দিনে জন্মেছে বলে যে একই রাত্রে বিয়ে হতে হবে তার কী মানে? দুদিনের নেমন্তন্নটা বা ছাড়ব কেন আমরা?
তারপর একটু দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলেছিলেন মাস্টারমশাই। বলেছিলেন, ওদের তো আর ছোট বড় বলে
কিছু নেই? যাকে হোক লাগিয়ে দেবেন।
সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নেড়েছিল পিসি, উঁহু, ছোট-বড় আছে বইকী! এক ঘণ্টার বড়ও বড়। নমুকে আমি সুমিকে দিদি বলতে শিখিয়েছি, দেখনি? দিদির বিয়েই আগে হবে।
.
পিসি বলেছিল, মেয়েদুটোর মা নেই, বাপ নেই। মা বাপওলা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব।
তা পিসির প্রতিজ্ঞাপূরণ হলেও সাধ মিটল না।
পাত্রের মা বাপ আছে, কিন্তু থেকেও নেই।
বৃন্দাবনে গুরু-আশ্রমে থাকেন তাঁরা। অবিশ্যি ছেলেটাকে মানুষ করে রেখে গেছেন। চাকরি-বাকরি করে, কাকার বাড়ি থাকে। বিদেশে বদলি হবার আশা আছে।
শুনে পিসির পছন্দ হয়নি।
বলেছিল, ও আর কী-ভাল পাত্তর আনলে তুমি প্রফুল্ল?
আমি আড়ালে হেসে বললাম, এই খুঁত বর নিয়ে আসার পিছনে মাস্টারমশাইয়ের কোন মনস্তত্ত্ব কাজ করছে বুঝতে পারছিস দিদি?
দিদি সব দিনের মতোই বলল, দূর অসভ্য!
কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের প্যাঁচ কাজে লাগল না। পাত্র সম্পর্কে আগে যতই নাক উঁচু করুক পিসি, দেখে একেবারে বিমোহিত হয়ে গেল।
দেখতে আসবে বলেছিল, না করলে মাস্টারমশাই অপদস্থ হবেন ভেবে রাজি হয়েছিল পিসি। বলেছিল, পরে ঠিকুজি কুষ্টির অমিল তুলে ভেঙে দেব। মা বাপ বৃন্দাবনবাসী, ও আবার কী সংসার।
কিন্তু দেখে ওই যা বললাম–মোহিত।
কনে দেখতে পাত্র নিজেই এসেছিল কিনা! পাত্র, আর তার বন্ধু।
দীর্ঘসুন্দর দেহ স্বাস্থ্যে উজ্জ্বল, আর চুল থেকে নখ পর্যন্ত যেন প্রাণের দীপ্তিতে ঝকমক করছে। কথা ধারালো, হাসি সুন্দর। কে বলবে বৃন্দাবনবাসী মা বাপের ছেলে। হয়তো বা এ একরকম প্রতিক্রিয়া।
যাই হোক, পাত্র দেখেই পিসি জামাই বলতে শুরু করল। আর রূপ-গুণের কথা বলতে বলতে গলে গেল।…
বয়েস থাকলে নিজেই বোধ করি প্রেমে পড়ে যেত পিসি।
চালাকি কাজে লাগেনি, তবু শেষ চালাকি করেছিলেন মাস্টারমশাই। বলেছিলেন, একটা মজা করুন না মা! দুজনকে একরকম সাজিয়ে রেখে দিন। পরে নমিতাকে দিয়ে চা দেয়াবেন, খুব ধাঁধায় পড়ে যাবে।
পিসি এ মজাটায় মজা পেয়েছিল।
বলেছিল, তা মন্দ বলোনি বাবা! তা ছাড়া বড় জামাইকে দেখিয়ে বলেও রাখি যদি ওর বন্ধু বা আত্মীয়ের মধ্যে কোনও পাত্তর থাকে। দুটি বোন জোড়ের পাখি, কাছাকাছি থাকতে পেলে বাঁচবে।
এ প্রস্তাব আমার কাছে অপমানকর। আমি এ প্রস্তাবে রাজি হব না ভেবেছিলাম।
এক ঘণ্টার দাবিতে দিদি টিকিট পেয়ে গিয়েছিল বলে রাগে হাড় জ্বলে যাচ্ছিল আমার। তবু রাজি হয়ে গেলাম। একটা বিবাহযোগ্য পুরুষের সামনে বেরোবার সুযোগ পেয়ে, সে লোভ ছাড়তে পারলাম না।
দুজনের এক সাজের অভাব ছিল না।
প্রত্যেক সময় একই সাজপোশাক হত আমাদের। আশৈশব।
সেই বছরেই পুজোর সময় দুজনেরই টুকটুকে লাল ভয়েলের শাড়ি হয়েছিল, বড় বড় সাদা রেশমের ফুল দেওয়া। দিদিকে তাই পরিয়ে কনে দেখানো হল।
মাথা নিচু করে বসে থাকল দিদি। কথার উত্তর না ই দিয়ে সারল। চা, জলখাবার দেবার সময় আমিও এলাম সেই সাজে, দিব্য সপ্রতিভ ভঙ্গিতে। ২৫৮
বলা বাহুল্য, ওরা প্রায় হোঁচট খেল। কনের একটি যমজ বোন আছে, এ কথা তাদের বলা হয়নি। কাজেই বিভ্রান্ত না হয়ে করবে কী? পিসেমশাই কনে দেখানোরূপ গুরুতর কর্তব্য সেরে দিয়েই কেটে পড়েছিলেন। মাস্টারমশাইয়ের উপর ছিল বাকি ভার।