কাজেই পিসি যখন বলল, বলল কী প্রফুল্ল, মেয়েরা ধেই ধেই করে কলেজে পড়তে যাবে? বংশের একটা মান-মর্যাদা নেই?তখন আমরা অবাক হলাম না।
শুধু কলেজে পড়ব এমন একটা রোমাঞ্চময় আশা, কেবলমাত্র ছলনা করে গেল, এইটাই বুকে বাজল। পিসি যখন ও পথ দিয়ে গেছে তখন আর আশা বৃথা।
তবুনমিতা নামের দুঃসাহসী মেয়েটা বলে ফেলেছিল, কী হয় পড়লে? কত বড় বড় ঘরের মেয়েরা তো পড়ছে—
প্রফুল্ল মাস্টারও তাড়াতাড়ি বলেছিলেন, হ্যাঁ, আমিও তো তাই বলছিলাম, কত বড় বড় ঘরে আজকাল
পিসি দৃঢ় গলায় বলেছিল, তা হোক। তুমি ও বুদ্ধি ছাড়ো বাবা! বরং বলে রাখি, দুটি সুপাত্রের সন্ধান এনে দাও আমায়! এইবার বিয়ে দিয়ে ফেলে আজন্মের দায় থেকে মুক্ত হই।
প্রফুল্ল মাস্টারের মুখটা অবশ্য আর প্রফুল্ল থাকেনি। কারণ, দিদির উপর বিশেষ একটা উচ্চ ধারণা ছিল তাঁর, হয়তো বা (ডবল বয়েস হওয়া সত্ত্বেও) একটু দুর্বলতা।
পড়লে দিদি যে একটা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট হবে এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তিনি রেজাল্ট বেরোনোর দিন থেকে বহুবার।
তাই সুপাত্র খোঁজার কথায় মুখটা বেচারার মলিন হল। যদিও সেই দুবুকে পকেট লাগানো খাকি শার্টের সঙ্গে বঙ্গলক্ষ্মী মিলের বেয়াল্লিশ ইঞ্চি ধুতি পরা নিরেটমুখো সেই লোকটার মুখের মলিনতা খুব বেশি রেখাপাত করল না আমার মনে। আমি শুধু অপেক্ষায় রইলাম, কখন একা হব, সুপাত্র খোঁজার ভার পেয়ে মাস্টারমশাইয়ের মুখের রং পরিবর্তন নিয়ে কখন দিদিকে খ্যাপাব।
মাস্টারমশাইকে নিয়ে খ্যাপাতাম আমি দিদিকে।
দিদি অস্বস্তি পেত।
বলত, মাস্টারমশাই না গুরু! গুরুকে নিয়ে ওসব কী ঠাট্টা রে নমু? ছিঃ। ডবল বয়সী উনি আমাদের। আমি হি হি করে হেসে বলতাম, তাতে কী? মাস্টারমশাই তো তোকে দেখতে দেখতে গলে যান।
তা হলে তোকে দেখতেও দিদি ধমক দিতে চেষ্টা করত, দুজনে তো একই রকম দেখতে।
শোনো কথা! দেখতে হলেই হল? তুই হলি প্রথম বিভাগ, আমি তাই?
পিসি আর একবার জোর দিল, হ্যাঁ বাবা, ওই কথাই রইল। অনেক জায়গায় যাওয়া-আসা আছে তোমার, বিদ্যে বুদ্ধি কুলশীল আকার-প্রকার সব দিকে একরকম দুটি পাত্র তুমি দেখবে।
পিসির কথা শুনে মাস্টারমশাইয়ের হয়ে উত্তর দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল আমার, তা হলে খুঁজে বার করো তোমার ভাইঝিদের শুভ-জন্মগ্রহণের পাঁচ-সাত বছর আগে তোমাদের সঙ্গে জাতিগোত্র কুলশীল মিলোনো আর কোথায় কোন ভদ্রমহিলা যমজ পুত্র প্রসব করেছিলেন এবং তারা সুস্থ শরীরে জীবিত আছে।
কিন্তু বলা গেল না।
পিসি সেই বাঁচালতা দেখে মূৰ্ছা যেত তা হলে।
প্রফুল্ল মাস্টার তাঁর পাতানো মাতৃদেবীর নির্দেশ অনুযায়ী পাত্র খুঁজতে শুরু করলেন, আর আমরা দুটি যুগলকমল প্রেম-ভালবাসা মিলন-বিরহের স্বপ্ন-সরোবরে ভাসতে লাগলাম।
কিন্তু সুমিতা কি সত্যি ভাসত?
সুমিতার মধ্যে কি সেই আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়েছিল?
বুঝতে পারতাম না।
এক থালায় ভাত খেয়ে, আর এক বিছানায় শুয়েও দিদির হৃদয়-রহস্য ঠিক ধরতে পারতাম না আমি। বুঝতে পারতাম না দিদির মধ্যে যৌবন নামক বস্তুটা উদ্বেল হয়ে উঠেছে কিনা। হঠাৎ এক ঝলক ফাগুনে-হাওয়ায় উতলা হয়ে ওঠে কিনা দিদি, আবেগে আবেশে কারও মুখের পানে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে কিনা দিদির, আর রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে একখানা চওড়া বুকের মধ্যে আশ্রয় নিতে, তার গলা জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে কিনা তার।
সন্ধ্যাবেলা পিসি যখন রান্নাবান্না সেরে ঠাকুরতলায় পাঠ শুনতে যেত, আর পিসে বৈঠকখানায় দাবায় বসত প্রফুল্ল মাস্টারের সঙ্গে, তখন আমি চয়নিকাখানা খুলে ভোলা গলায় পাঠ করতাম–
হে আমার চির ভক্ত একি সত্য? সবই সত্য?
চির-মন্দার ফুটেছে আমার মাঝে কি?
চরণে আমার বীণা ঝঙ্কার বাজে কি?
নিশির শিশির ঝরে কি আমায় হেরিয়া?
প্রভাত আলোর পুলক আমাকে ঘেরিয়া?
অথবা পাঠ করতাম—
আমার যৌবন স্বপ্নে যেন ছেয়ে গেছে বিশ্বের আকাশ
দিদি তথন দিব্যি ছুঁচ সুতো নিয়ে পিসির ফরমায়েশি সেলাইগুলো পেড়ে বসত। সেলাই না থাকলে সন্ধ্যার আগেই দিদি বলত, পিসি, রোজ হাঁফাহাঁফি করে কষ্ট পাও কেন? যাও না তুমি, রুটিগুলো না হয় আমি সেঁকে রাখব।
এক-আধদিন রেগে বলতাম, এই সুমি মুখপুড়ি, পোড়ারমুখি, ওইসব হতচ্ছাড়া কাজ ভাল লাগে তোর এ সময়?
সুমিতা হেসে বলত, কাজের আবার সময় অসময়। সেরে ফেললেই হয়ে গেল।
বলত।
কিন্তু সেরে ফেলতে দিদি পারত না। দুঘণ্টা লাগত ওর খানকয়েক রুটি সেঁকতে। পিসি পাঠ শুনে এসে দেখত তখনও দিদি রুটি ওলটাচ্ছে। কিছু বা ছিঁড়েছে, কিছু বা পুড়িয়েছে। পিসি দেখে গালে হাত দিত।
নয়তো বলত, পারিস না, করতে আসিস কেন বাছা? যে পারে, সে তো উপর বারান্দা থেকে নামে না।
সেলাইয়েও তথৈবচ।
একটা বালিশের ওয়াড় সেলাই করতে দিদি দিনের পর দিন পাড়ত তুলত।
কোনও কোনও দিন আমি কেড়ে নিয়ে চটপট সেরে দিয়ে তুলে রেখে বলতাম, পড়, পড় একটু প্রেমের কবিতা, এরপর নইলে বরের কাছে ঠকে যাবি
দিদি হাসত। দিদির হাসিটা বড় মিষ্টি ছিল।
বলত, তুই পড়ছিস, শুনছি তো৷।
আমি পড়লেই তোর হবে? আমি খেলে তোর খাওয়া হয়?
দিদি আরও হাসত, যমজের শুনেছি তাও হয়।
তবে শোন,বলে হয়তো আরম্ভ করতাম আমি
তোমারেই যেন ভালবাসিয়াছি শতরূপে শতবার।
যুগে যুগে অনিবার।