তাই দিদি পরক্ষণেই বলত, যা বলেছিস, পিসির মতো ছিল না কখনও। ভাইবোন বলেই যে একরকম দেখতে হবে তার মানে নেই। আমাদের মতো যমজ তো আর নয়!
এ সব বই, সমস্ত বই বাবা পড়েছিলেন মনে হয় তোর? বলতাম আমি।
দু-তিনটে আলমারি বই পড়ে ফেলা দিদির কাছে সত্যি সমুদ্র-জল পান করার মতোই, তাই দিদি হেসে ফেলে বলত, ধ্যেৎ।
আমি বলতাম, আমার কিন্তু স্থির বিশ্বাস, সব পড়েছেন বাবা। নতুন বই কিনে কেউ তুলে রাখতে পারে? একটা করে কিনেছেন, পড়ে তবে আলমারিতে সাজিয়েছেন। এই হচ্ছে ঠিক।
দিদি বলত, এমনি কিনে রেখে দেওয়া যায় না বুঝি?
আমি বলতাম, যায়। যাবে না কেন? ভাত বেড়ে নিয়ে বসে না খেয়েও কি থাকা যায় না? তবে থাকে কি কেউ?
তা পদ্যর বইগুলো কি কেউ পড়ে?
পড়ে না? আমি হি হি করে হাসতাম।
পড়ে না তো লেখা হয় কেন?
আহা, সে তো স্কুলে রেসিটেস্যান করতে কিংবা
আমার হাসির ঝাপটায় দিদির হাসি বন্ধ হয়ে যেত।
অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে নিজেও হাসত দিদি।
কিন্তু এসব কথা আমরা খুব ছেলেবেলাতেই কইতাম। বছর আট কি নয় বড়জোর।
বড় হয়ে তা বলে দিদি অত বোকা ছিল না।
নিজস্ব একটা স্বাভাবিক বুদ্ধি দিদির মধ্যে গড়ে উঠেছিল। দিদি বুঝতে পারত কোন কথার কী পরিণাম হতে পারে, কোন মনোভাবটা শুভ, আর কোনটা শুভ নয়। পিসেমশাইকে পর্যন্ত বলতে শুনেছি, সুমিতার মতন মেয়ে হয় না। লক্ষ্মী মেয়ে।
সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য নমিতা নামের মেয়েটার সমালোচনা হয়েছে। বলা বাহুল্য, সে সমালোচনা নমিতার অনুকূল নয়।
কিন্তু তাতে কিছু এসে যেত না নমিতার।
নমিতা ওই বোকা সুমিতার মতো কেয়ার করত না, কে কী ভাবছে। পিসের মতো একটা গাঁইয়া লোকের, বা পিসির মতো একটা নির্বোধ মেয়েমানুষের নিন্দে সুখ্যাতিতে কিছুই এসে যেত না তার।
বাবার ওই বইয়ের রাজ্যে ছিল নমিতার আশ্রয়।
সুমিতা আশ্রয় খুঁজত সংসারের মাপা গণ্ডির মধ্যে।
আশ্চর্য! মানুষ কত বদলায়!
কত ওলটপালট হয়ে যায় তার চিন্তাধারা! কী অদ্ভুত সিদ্ধান্তেই না পৌঁছতে পারে সে হঠাৎ। আর কত সহজেই ভেঙে পড়ে তার আশ্রয়!
২. দিদি ডাকের মর্যাদা
সুমিতা তার ছোট বোনকে ভালবাসত, ঘোটর মতোই মায়া করত, দিদি ডাকের মর্যাদা রাখত।
নমিতা সেই ভালবাসা সেই মমতা অগ্রাহ্য করতে পারত না, ছোটর মতোই খাকত, কিন্তু ভিতরে ভিতরে দিদির থেকে নিজেকে অনেক বড় ভাবত। বুদ্ধিতে বড়, বিদ্যেতে বড়। সুক্ষ্ম রসবোধে আর শিল্প
সৌন্দর্য-সংস্কৃতির রুচিবোধে দিদিকে নিজের থেকে নেহাতই ক্ষুদ্র মনে হত তার।
নমিতা যে বিশিষ্ট একজন, আর সুমিতা যে শুধুই একটা জন মাত্র, এ ধারণা জন্মে গিয়েছিল নমিতার অস্থি-মজ্জায়।
পিতৃপক্ষের এবং পিসির পক্ষের আত্মীয়রা যখন দুই যমজ বোনের মধ্যে একজনকে ল্যাংড়া এবং অপর জনকে আমড়ার সঙ্গে তুলনা করত, নমিতা অবজ্ঞাভরে তাকিয়ে দেখত, যারা করছে তারা কোন দরের লোক।
.
এমনি করতে করতেই ম্যাট্রিক পাস করল তারা।
বোকা সুমিতা প্রথম বিভাগে পাস করল, চালাক নমিতা দ্বিতীয় বিভাগে।
এটা যে নমিতার সম্পূর্ণ অবহেলার ফল তাতে আর সন্দেহ ছিল না। তবু সুমিতা যেন ওর ওই বিভাগটা নিয়ে মরমে মরে গেল। আর নমিতা সগর্বে বলে বেড়াতে লাগল, পরীক্ষায় গোটাকতক মার্ক বেশি পাওয়াই যাদের কাছে পরমার্থ, আমি তাদের দলে নই বাবা! বিবেকের দংশনে কিছুমাত্র কাতর হসনি দিদি, তুই মনের আনন্দে তোর ফার্স্ট ডিভিশনটা সোনার আলমারিতে তুলে রাখগে যা। ২৫৪
মেয়ে দুটো কলেজে পড়বে কি না পড়বে, এ কথা একবার উঠেছিল। মাস্টারমশাই নামক যে জীবটি আমাদের শৈশববাল্যের কর্ণধার ছিলেন, তিনি পিসিকে মা বলতেন। আর সেই সূত্রেই তাঁর যাতায়াত অব্যাহত ছিল। বলা বাহুল্য আমরা বড় হয়ে ওঠার পর অবধি পড়িয়ে চলবেন এত বিদ্যে ছিল না মাস্টারমশাইয়ের। কিন্তু হিতৈষীর পোস্টটা আঁকড়ে ছিলেন তিনি বরাবর।
যদিও পিসির মতো বুদ্ধিহীন মেয়েমানুষকে যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় মা ডেকে সম্পর্ক পাতায়, তার বুদ্ধি বিবেচনার উপর আমার অন্তত কিছুমাত্র আস্থা ছিল না।
তথাপি মাস্টারমশাই বলেছিলেন, ভর্তি করতে হলে এখনই অ্যাপ্লাই করতে হবে, দেরি করাটা ঠিক নয়। কিন্তু পিসি কলেজের নামে নাক তুলেছিল। বলেছিল, কলেজে পড়বে কী? তুমি বলছ কি বাবা! ছিঃ!
মাস্টারমশাই আমাদের জন্যে অনেক জল ঢেলেছিলেন, কিন্তু মাটি ভিজল না। কঠিন থাকল পিসি, আর জীবনে এই দেখলাম, একটা ব্যাপারে পিসি আর পিসে একমত হল।
পিসেও বলল, তুমি বলো কী মাস্টার? কলেজে ভর্তি হবে কি? চাকরি করবে নাকি?
মাস্টারমশাই নগলায় বললেন, কলেজে পড়লেই যে চাকরি করতে হবে তার কী মানে? পড়ার জন্যেই পড়া। আজকাল কত মেয়ে কলেজে পড়ছে।
পিসে বলল, তা সে ফ্যাশানের জন্যে তো টাকা চাই, কলসির জল গড়াতে গড়াতে তো তলায় ঠেকেছে।
মাস্টারমশাই সবিনয়ে বলেছিলেন, ফ্রি-তে পড়ার ব্যবস্থা যদি করতে পারেন তিনি, তা হলে কি
.
পিসেমসাই ছিটকে উঠলেন।
বললেন, ছি ছি, বলো কী মাস্টার? বংশের একটা প্রেসটিজ নেই? দেবেশ মুখুজ্যের মেয়েরা পড়তে যাবে দয়ার ভিখিরি হয়ে?
আমাদের বংশের মর্যাদা সম্পর্কে পিসেমশাইকে কখনও মাথা ঘামাতে দেখিনি। অবাক হলাম।
তবে পিসির ব্যাপারে অবাক হবার কিছু ছিল না। পিসি তাঁর বাপের বংশের মান-মর্যাদা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। অহরহই ভাইঝিদের শিক্ষা দিতেন, মনে রাখিস কত বড় বংশের মেয়ে আমরা।