- বইয়ের নামঃ রাতের পাখি
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১ মৃত্যুর মন্থর পদধ্বনি
রাতের পাখি – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
বহুদিন থেকে মৃত্যুর মন্থর পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল দূরবর্তী বলদের গলার ঘণ্টাধ্বনির মতো। যেন নিয়ে যাবার গাড়ি আসছে প্রস্তুত হয়ে, সময় হাতে থাকার অলস মন্থরতায়।
হঠাৎ হঠাৎ কোনও এক সময় সে ধ্বনি অস্পষ্ট হয়ে গেছে, মনে হয়েছে বুঝি থেমে গেল। হয়তো ও গাড়ি আর আসবে না, ভুল রাস্তায় আসছিল ভেবে ফিরে গেছে। আবার হঠাৎ একদিন শোনা গেছে। সেই আওয়াজ, দ্রুত স্পষ্ট। যেন অনেক ক্ষণের শিথিলতার ক্রটি সামলে নিচ্ছে।
এরা তখন অনিবার্যের আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছে, ভয় পেয়েছে, দরজায় মুখ বাড়িয়ে দেখেছে, কিন্তু চাকার ধুলো ছাড়া আর কিছু চোখে পড়েনি।…
ক্রমশ এরা উদ্বিগ্ন হওয়ার অভ্যাসটা ছেড়েছে। রাত্রে উৎকর্ণ হয়ে থাকতে ভুলে গেছে। নিশ্চিন্ত জেনে নিয়েছে সকালে ঘুম ভেঙে উঠে চিরস্থায়ী ওই দৃশ্যটা দেখতে পাবেই। দেখতে পাবে, সামনের ওই ঘরটায় উঁচু পালঙ্কের উপর ফরসা ধবধবে বিছানায় বালিশে কনুই ঠেকিয়ে আধবসা হয়ে শুয়ে আছেন প্রিয়মাধব। দৃশ্যটা যেন অনন্তকালের পৃথিবীরই একটা অচ্ছেদ্য অংশ।
প্রিয়মাধব পালঙ্কের উপর আধবসা হয়ে শুয়ে আছেন। প্রিয়মাধবের সেই পালঙ্কের মাথার কাছের বাজুতে একখানা পাটকরা ফরসা তোয়ালে ঝোলানো আছে, আর প্রিয়মাধবের সামনে একটা নিচু গোল টেবিল আছে যার উপর থরে থরে সাজানো আছে শিশি বোতল কৌটো। প্রিয়মাধবের খাটের নীচের দিকে একটু তফাতে দেয়ালের গা ঘেঁষে একটা মাঝারি মাপের জালের আলমারি আছে, তার মাথার উপর প্রিয়মাধবের খাবারের প্লেট, গ্লাস, চামচ, ফিডিংকাপ, জল রাখবার কাঁচের জার সাজানো আছে, আর তার ভিতরে প্রিয়মাধবের মজুত করা খাদ্যবস্তু আছে। জানা কথা, ওটা হাতড়ালে আচার আমসত্ত্ব থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি অন্তত একশো জিনিস মিলতে পারে।
প্রিয়মাধবের পালঙ্কের ওধারে দুটো জানলার মাঝখানে একটা আলনা আছে, তার গায়ে প্রিয়মাধবের জামা কাপড় গেঞ্জি গোছানো আছে, কোণের কোনাচেগড়ন বুকসেলফটায় কয়েকখানা মোটা-সোটা ভারী বাঁধাই ইংরেজি বই আছে, যার মলাটের নামটা একসময় সোনার জলে লেখা ছিল, এখন বিবর্ণ আর অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
এ ছাড়াও প্রিয়মাধবের ঘরে একটা ছোট্ট স্টিলের লকার’ আছে, যার চাবিটা এখনও প্রিয়মাধবের আয়ত্তে। আর একটা বেতের চেয়ার আছে, যেটায় তাঁর নার্স বসে। প্রিয়মাধব কত কত কাল যেন মাটিতে পা ঠেকাননি, তবু তাঁর খাটের পায়ের কাছে পাপোশের উপর এক জোড়া চটিজুতো সাজানো আছে।
প্রিয়মাধবের ঘরের এই দৃশ্যের পরিবর্তন নেই, ঘরের কোনও জিনিস এক ইঞ্চি এদিক-ওদিক করতে দেন না প্রিয়মাধব। শুধু খুব ভোরবেলায় এ-ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালে দেখা যায় ওঁর ওই ওষুধের টেবিলের কাছে একটা টুল পড়েছে। এবং তার উপর বড় একটা এনামেলের গামলা বসানো হয়েছে প্রিয়মাধবের মুখ ধোওয়ার জন্যে।
নার্স মুখ ধুইয়ে দিয়ে সেটা সরিয়ে নিয়ে যেতে এক মিনিট দেরি করলেই প্রিয়মাধব বিদ্রুপের গলায় বলেন, নার্স, এই দৃশ্যটা কি তোমার খুব সুন্দর বলে মনে হচ্ছে? নার্সের একটা নাম আছে, সেটা এমন কিছু দুরুচ্চাৰ্য নয়। নিজে সে অনেকবার বলেছে, আপনি আমায় নীহার বলেই ডাকবেন। প্রিয়মাধব সে অনুরোধ রাখেননি। ওই বিদ্রুপের ভঙ্গিতেই বলেছেন, চিরকাল তুমি আমার পরিচর্যা করবে এ গ্যারান্টি দাও তো নামটা মুখস্থ করার কষ্ট স্বীকার করি। ছমাস পরে আবার কে আসবে, আবার আমি তার নাম মুখস্থ করতে বসব, ঝুটমুট অত খাটতে পারব না।
নার্স অবশ্য চিরকালের গ্যারান্টি দেয়নি। অতএব নার্সই বহাল আছে। ছেলের কাছে এ গল্প করে হেসেছেন প্রিয়মাধব। বলেছেন, মেয়েমানুষ জাতটার এই এক দোষ বুঝলি, কিছুতেই কোনও একটা সম্পর্ক না পাতিয়ে স্বস্তি পায় না। যেই আমি নাম ধরে ডাকতে শুরু করব, ও-ও তক্ষুনি মেসোমশাই কি কাকাবাবু ডাকতে শুরু করবে নির্ঘাত। কী কাজ বাবা আমার অত ঝামেলায়?
প্রিয়মাধবের ছেলে অরুণমাধব অবশ্য ওই ডাকটাকে খুব একটা ঝামেলার ব্যাপার বলে ভাবেনি। নীহারের মতো একটি সভ্য-ভব্য ভদ্র মেয়ে যদি প্রিয়মাধবকে মেসোমশাই কি কাকাবাবু ডাকে, সেটা খুব একটা বিরক্তিকর বলেও মনে হয়নি তার। তবু সে বাবার কথার প্রতিবাদ করেনি, শুধু বাবার এও একটা বাতিক ভেবে মৃদু হেসেছিল।
এ ঘরে, নিজেদের দিকে তারা নীহারকে বাড়ির অতিথির মতোই স্নেহ সম্মান দেয়, তার সঙ্গে ভালভাবে কথা বলে, কিন্তু বাবার ঘরে নীহার সম্পর্কে নির্বিকার থাকতে হয়। অনেক সময় মিথ্যা ধমকের ভানও দেখাতে হয়। হয়তো বলতে হয়, এ কী? বিছানার চাদরটা কি আজ পালটানো হয়নি? ফ্রেশ দেখাচ্ছে না তো? অথবা, কী আশ্চর্য, ফলগুলো অমন খোলা ফেলে রেখেছেন কেন? এই এক গাফিলি আপনাদের!
এটা নীহারেরই শিক্ষা।
নীহারই বলে রেখেছে, বকবেন, ওঁর সামনে আমাকে খুব বকবেন। এটা ওঁর ওষুধের কাজ করবে।
অরুণমাধবের বউ উত্তরা অবাক হয়ে বলেছিল, কেন বলুন তো?
তাই হয়।নীহার হেসে বলেছিল, বেশি দিন বিছানায় পড়ে থাকতে থাকতে মানুষের মেজাজ তিক্ত হয়ে ওঠে। আর তার উপরই সব থেকে বেশি রাগ হয়, যে এই অসহায় অবস্থার সাক্ষী। অতএব সবাই মিলে তাকে বকছে গাল দিচ্ছে, এটা দেখতে ভাল লাগে।