ঠিক আছে, তাই দেব।
বাবা যদি বলেন, আমরা বাড়িতে তোমার স্ত্রীর জায়গা হবে না—আবার এইখানেই ফিরিয়ে আনবে?
উঃ!
সম্বুদ্ধ হতাশ গলায় বলে, উঃ! আজকের দিনেও সেই অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা? সেই টাকা-আনা পাইয়ের হিসেব? কই, এতদিন তো মনে হয়নি তুমি রক্তমাংসের মানুষ নও, পাথরের?
এতদিন রক্ত-মাংসের খোঁজ করনি বলেই হয়তো টের পাওনি।
ঠিক আছে। তোমার বাবা যদি মেয়েকে তাড়িয়ে দেন—
ইলা বলে, ভুল বলছ, বাবার মেয়েকে নয়, তোমার স্ত্রীকে।
তর্কটা বাধা পেল।
কুমকুম আর অসীম এসে পড়ল হইচই করে। এল আর কজন বিবাহিত, অবিবাহিত বন্ধু। ফুল নিয়ে, উপহার নিয়ে। বিছানার ছড়িয়ে দিল গোলাপের পাপড়ি, ইলার খোঁপায় পরাল গোড়ে মালা। আরও দুগাছা মালা রইল মজুত বদলের জন্যে।
সম্বুদ্ধর খরচে খেল সবাই।
তারপর বলল, গুডবাই।
কুমকুম চুপিচুপি বলে গেল, চলে যাব চলে যাব বলে পাগলামী করিস না। থেকে যা। সকালে আমার ওখানে যাবি, পৌঁছে দেব তোকে। আর রাত্রে যাহোক কিছু একটা খবর দিয়ে দেব তোদের বাড়িতে।
ইলাও বলল, পাগলামী করিস না। নাইট শোয়ে সিনেমা দেখার টাইমটা হাতে আছে, ওই বেশ।
ওই বেশ? সম্বুদ্ধ রেগে বলে, তুমি এমন ভাব করছ যেন সবটাই অবৈধ।
কি করব? মনের মধ্যে বৈধের সুর বাজছে না যে! বাড়ি ঢুকব কি করে সেইটাই মনের মধ্যে প্রধান হয়ে উঠছে।
বললাম তো কাল সকালে গিয়ে সব প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়ে নেব।
বেশ!
বেশ। সম্বুদ্ধ ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলে, এত হিসেব কসার পর আবেগ-ইচ্ছে, বাসনা কামনা সব ডানা মেলে উড়ে যায়।
বলে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার পরিচয় দেয় না। প্রবল বাসনার প্রচণ্ড আবেগে ইলাকে গুঁড়ো করে ফেলবার জেদ ধরেছে যেন।
ইলা মরে যাচ্ছে।
ইলা হারিয়ে যাচ্ছে।
ইলা তার ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সব একাকার করে ফেলছে।
এখন যা করবে সম্বুদ্ধ। সব ভার তার, সব চিন্তা তার। ইলার নিজস্ব কোনো সত্ত্বাও বুঝি রইল আর। নিজস্ব চিন্তাশক্তি।
.
কিন্তু সম্বুদ্ধই নতুন চিন্তায় এল।
দেখ, এখন মনে হচ্ছে তোমার বুদ্ধিটাই ঠিক হয়েছিল।
ইলা আস্তে বলল, কি?
মানে আর কি ফিরেই যাওয়া। এখনও সময় রয়েছে। পৌনে বারোটা বেজেছে। নাইট শো ভাঙছে।
আমি পারব না।
আহা, বুঝছ না–
আগে তো বুঝছিলাম, এখন বুঝতে চাই না।
সম্বুদ্ধই তখন বোঝাতে চেষ্টা করে। কে বলতে পারে রাত কাবার করে সকালে ফিরতে দেখে ইলার বাবা পাড়া জানাজানি করে যাচ্ছেতাই করবেন কি না।…অপমানের শেষ থাকবে না তখন। বোঝাতে তো সময় লাগবে।
এখন এতরাত্রে নিশ্চয় তা করবেন না। আর তাড়িয়ে দিতেও পারবেন না।
এখনই ঠিক, এখনই সুবিধে।
তার মানে তুমিই তাড়িয়ে দিচ্ছ?
ক্লান্ত চোখ তুলে বলে ইলা।
সম্বুদ্ধ অবশ্য এ-প্রশ্নের উত্তর যথাযথ দেয়। তারপর বলে, যক্ষের অভিশাপের দিন কটা শেষ হতে দাও একবার।
ইলা শিথিল গলায় বলে, মা ঠিক ধরে ফেলবেন।
কেন? না না, অকারণ ভয় পাচ্ছ। গাড়ির মধ্যে কে আছে না আছে এত রাত্রে কে দেখেছে? তুমি একটু গলা তুলে বলবে, কুমকুম, তোর আর এত রাতে নামবার দরকার নেই, বাড়ি চলে যা।
ইলা ঝেঁজে ওঠে।
মানে, তোমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার খেসারত দিতে অবিরত অভিনয় করে চলি?
সম্বুদ্ধ বলে, লাঠি না ভেঙে যদি সাপটা মারা যায়—
অথচ খানিক আগে লাঠিটাই ভাঙছিলে—
সম্বুদ্ধ একটু করুণ করুণ গলায় বলে, আমি তোমার মতো পাথরের দেবতা নই ইলা।
.
এইভাবেই ইলার ফুলশয্যার শয্যা থেকে বিদায়-গ্রহণ।
বাড়ি ফেরার সময় যথারীতি অভিনয়টা করতে হল। কুমকুম আর কুমকুমের দাদা গাড়িতে আছে, নামিয়ে দিয়ে গেল ইলাকে। ইলার সর্বাঙ্গে ফুলের গন্ধ জড়ানো, ইলার সর্বদেহে বিবশ শিথিলতা।
ইলা কি ওই অভিনয়টুকু করেই পার পেয়ে যাবে? দরজা খোলার মুহূর্তে প্রস্তুত হয়ে থাকে ইলা ঝড়ের মুখে পড়বার জন্যে। নিশ্চয় বাবা দরজা খুলবেন, আর তীব্র ভর্ৎসনা করবেন। প্রশ্ন করবেন কোন্ হলে ছবি দেখতে গিয়েছিল তারা। ইলা এই সৌরভে-আকুল দেহটা নিয়ে দাঁড়িয়ে কি উত্তর দেবে বাবাকে?
যদি তেমন অপমানের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় ফিরে আসবে ইলা, এই ঠিক করা ছিল?
গাড়িটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে সম্বুদ্ধ রাস্তার এ-ধারে।
নিয়ে চলে যাবে ইলাকে।
পরদিন সম্বুদ্ধ দেখিয়ে যাবে দলিল। শুনিয়ে যাবে দুকথা।
মানে সেটা সম্বুদ্ধর মত।
এ-সবই যদির উপর ছিল।
কিন্তু দরজা খুলে দিলেন মা।
আর ইলা ঢুকতেই বলে উঠলেন, বন্ধুর বুঝি জন্মদিন ছিল? কই, কিছু তো নিয়ে গেলি না?
ইলা আস্তে বলে, জন্মদিন নয়।
তবে? শুধু শুধুই? বড়োলোকদের যা সাধ হয় মেটাতে পারে। খোঁপার মালাটা কুমকুমই দিয়েছে বুঝি? কী চমৎকার গন্ধ! ঢুকলি যেন একটা বিয়ে-বাড়ি নিয়ে এলি সঙ্গে করে।
ইলা চমকে তাকাল।
না, অমলার মুখে কোনো অভিসন্ধির ছাপ নেই। সেই তাঁর সবেতেই খুশিভাব নিয়েই কথা বলছেন, আস্তে আস্তে চল। এইমাত্র ঘুমিয়ে পড়েছেন উনি। বারবার দেখছিলেন, আমিই বকে বকে ঘুমোতে পাঠালাম। বলি যে, তোমার ইচ্ছাশক্তির প্রভাবে কি সিনেমা এগারোটার আগেই ভেঙে যাবে?..ভাগ্যিস ঘুমিয়ে পড়েছেন! রাতও কিন্তু তোদের বড় হল। খুব বড়ো বই বুঝি?
এরপরও কি ইলার ভিতরের আবেগ চোখের কিনারায় ফেটে পড়তে চাইবে না?
এই মা।
স্বপ্নেও ধারণা করতে পারবেন না কতবড় ঠগ-জোচ্চোর তার ছোটো মেয়ে।