মায়ের সঙ্গে যেন বহুযোজন দূরত্ব এসে গেছে এ-ইলার। খেতে বসে দুই মায়ে-ঝিয়ের সেই প্রাণ-খোলা আর গলা-খোলা গল্পের স্রোত যেন আর বইবে না। যেন বড়ো একখানা পাথরের চাই এসে পড়েছে তার মুখে।
খাচ্ছিস না তো মোটে–
বললেন অমলা।
ইলা বলল, খাচ্ছি তো! খেতে লাগল জোর করে।
মা মনে মনে হাসলেন। ভাবলেন, হঠাৎ বিয়ের কথা শুনে মনটা উচাটন হয়েছে।
হবে, হতেই পারে।
অমলার যখন প্রথম বিয়ের কথা হয়েছিল, সাতদিন খেতে পারেনি ভালো করে।
হেমন্তর যেমন কাণ্ড, আগে কনে পাত্র পছন্দ করবে, তবে নাকি বিয়ের প্রস্তাব। শুনেও বাঁচি। ক্রমশ দেশের চাকা যেন ঘুরে উলটে গেছে। তা, এ-ছেলেকে আর অপছন্দ করতে হয় না। গুণেই তো পছন্দ। তাছাড়া দেখতেও ভালো। রঙ ময়লা বলেছে, সে তো ফটোতে তত বোঝাও যাচ্ছে না। এমনিতে নাক-মুখ-চোখ পরিষ্কার তী, যাকে প্রশস্ত ললাট বলে, তাই। আর সবটা মিলিয়ে একটা বুদ্ধিদীপ্ত পরিচ্ছন্নতা। অমলার খুব ভালো লেগেছে।
অমলার মেয়েরও লাগবেই।
.
তা, অমলার অনুমান হয়তো মিথ্যা নয়। অমলার মেয়ে সেই ছবিখানা হাতে নিয়ে বসে রয়েছে দীর্ঘ একটা সময়। রাত্রে ঘুমের সময়।
অমলার ঘরের পাশেই ইলার এই ছোট্ট ঘরটা। মাঝখানে দরজা, পরদা ফেলা থাকে। মানে থাকত।
সম্বুদ্ধর সঙ্গে ভাৰ হবার পর থেকেই কৌশলে ওই দরজাটা বন্ধ করে রাখার ব্যবস্থা করে ফেলেছে ইলা। বলে, পড়ার অসুবিধে।
কেন?
খুব স্পষ্ট একটা কারণও অথচ নেই। মাঝে মাঝে চিঠি লেখার শখ ইলার, তাই লেখে। সেটা কিছু না। আসলে নিজেকে একলা করে নিয়ে বসার একটা আলাদা সুখ, আলাদা রোমাঞ্চ।
মাঝখানের দরজা খোলা থাকলে মনে হয় যেন ইলার চিন্তাগুলো মা-র কাছে গিয়ে পৌঁছচ্ছে। যেন মায়ের চোখ ইলার নিভৃত হৃদয়ের দরজায় এসে দৃষ্টি ফেলছে। পরাধীনতার একটা বন্ধন যেন লেগে থাকে সর্বাঙ্গে। দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন লাগে।
তাই এ ব্যবস্থা করে নিয়েছে।
আজও দরজাটা বন্ধ করে দিল। বেশ একটা নিশ্চিন্ত সুখের আশা পেল যেন। বসল বিছানায়।
ভাবল ওই ছবি ওখানে থাক পড়ে। দায় পড়েনি আমার কার-না-কার একটা ছবি দেখতে। আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ল না।
বসেই রইল।
বসে থাকতে থাকতে মন ঘুরে গেল। ভাবল, দেখলেই বা কী?
ওই একটা ছবি দেখা না-দেখায় আমার কি এসে যাবে? বরং ওই না দেখে ফেলে রাখাটাই ওকে বড়ো বেশি গুরুত্ব দেওয়া যেন।
নিক্তির কাঁটা এদিকে ঝুঁকল।
ছবিখানা অবহেলাভরে হাতে তুলে নিল। একবার দেখেই ফেলে রাখল। তারপর আবার যেন নতুন কিছু একটা কৌতূহলে ফের তুলে নিল।
তারপর দেখছে।…দেখে দেখে যেন শেষ হচ্ছে না।
মুখ-চোখ মন্দ নয় লোকটার।
নেহাত বোকাটে বলেও মনে হচ্ছে না।…বিলেত-ফেরত ইঞ্জিনিয়ার শুনছি, বোকা হবার কোনো কারণও নেই অবশ্য।
তা, কনে একটা ভদ্রলোকের জুটবেই ভালো মতো।
ওদের বাড়িটাও ভালো বলেই বোধ হয়। সম্বুদ্ধদের মতো গোয়ালবাড়ি নয়। ভালো ভাবছি এই জন্যে, মা-বাপ আছে বলছিল দিদি, আর সে মা-বাপ যখন খরচা করে বাইরে পাঠিয়েছে ছেলেকে, ভালো হওয়াই স্বাভাবিক।…
নিজেদের জানাশোনা কারুর সঙ্গে বিয়েটা হলে মন্দ হত না। একটা জানা মেয়ের ভালো বিয়ে হত।
জানা মেয়ে খুঁজতে লাগল মনে মনে। হরিকাকা, মেয়ের বিয়ে বিয়ে করে পাগল হচ্ছেন।
হন বাবা! এই রূপে-গুণে আলো করা ছেলের সঙ্গে হরিকাকার মেয়ে! ছি ছি! বিদ্যে-বুদ্ধির বালাই মাত্র নেই মেয়েটার।
ন-মামার মেয়ে অতসী?
নাঃ, সে মেয়ে তো একটি ফ্যাশনের অবতার।
কেন একটা ভালোমানুষ ছেলের মাথাখাওয়া হবে!
বেলামাসির মেয়েটাও বিয়ের মতো হয়েছে, কিন্তু টাকাই আছে বেলামাসিদের, কালচার নেই।
তবে কে? তবে কাকে?
আরও অনেক মাসি-পিসি-কাকার কথা মনে মনে তোলপাড় করল ইলা। যাঁরা নাকি মেয়ের বিয়ের কথা বলে থাকেন। একটাকেও পছন্দ হল না। কোনোটাকেই যোগ্য মনে হল না।
এই সভ্য-ভব্য মার্জিত চেহারার লোকটার সত্যিকার একটা ভালো কনে হওয়া উচিত।
কে কোথাকার ওই লোকটার কনের চিন্তায় ইলা কেন মাথা ঘামাচ্ছে, সে কথা ভাবল না ইলা।
আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ার পরও আরও অনেকক্ষণ ঘামাতেই লাগল মাথা।
২. পরদিন স্নান করে
পরদিন স্নান করে এসে প্রথম চমক লাগল আরশির সামনে দাঁড়িয়ে।
বিয়ে হয়ে গেছে ইলার। অথচ সিঁথিতে এখনও কুমারীর নির্মল শুভ্রতা।
সিঁদুর এক প্যাকেট এনেছিল কুমকুম, বলেছিল বাইরে এসে সম্বুদ্ধ আংটি করে লাগিয়ে দেবে–আভাসে।
ইলা রাজী হয়নি। বলেছিল, জীবনে প্রথম সিঁদুর পরব যেখানে সেখানে? বলেছিল, থাক, ওই শুভরাত্রি না কি ওই দিনই যা হয় হবে।
তবু আজ সিঁথিটা দেখে মনটা কেমন করে এল। ইলার যদি সহজ স্বাভাবিক বিয়ে হত, আজ ইলার চেহারায় লাগত কী অপূর্ব রঙের ছোঁয়াচ। লাল শাড়িতে মহিমান্বিত নববধূ মূর্তির সিঁথির সেই অরুণ-রাগ, সারা মাথাটাই যাতে লালে লাল হয়ে গেছে, সেই মূর্তিটার বিরহ লাগল যেন ইলার। ইলা তাই আবার স্নানের ঘরে গিয়ে চোখে জল দিয়ে এল চোখের জল ঢাকতে।
ছবিখানা এখনও পড়ে আছে টেবিলে।
উলটো করে রেখে দিয়েছে ইলা।
খুলে রেখে মনে হচ্ছিল, ও যেন ইলার মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ-হাসি হাসছে।
এখন আর দেখতে পাচ্ছে না, তবু রাস্তায় হঠাৎ দেখতে পেলে ঠিক ওকে চিনে ফেলতে পারবে ইলা। ছবির মুখের প্রত্যেকটি রেখা যেন মুখস্থ হয়ে গেছে ইলার।