তাই বলেছিলেন, রাস্তায় ঘোরে, এটা দেখতে ভালো নয়। বাড়িতে এনে বসাও। তোমার মা-র সঙ্গে আলাপ করে দিও। খুশি হবেন।
ইলা বলতে পারেনি খুশি হবার মতো কি পাবেন মা-বাবা? মা তো কারও সামনে বেরোতেই চান না। এখনও সেই মধ্যযুগীয় প্রথায়।
.
বড়ো জামাইয়ের সঙ্গেও প্রথম প্রথম ঘোমটা দিয়ে কথা বলতেন ইলার মা। এখন খুব ফ্রী। সম্বুদ্ধর সঙ্গে মা-র এই ফ্রী কি জীবনে আসবে?…যদি সম্বুদ্ধর কথামতো পরে ভবিষ্যতে সব ঠিক হয়ে যায়ও।
হয় না। কাটা গাছ জোড়া লাগে না।
ভাঙা মন ঠিক খাপ খায় না।
ঘোষের ছেলেকে কিছুতেই সমাদরে জামাই বলে গ্রহণ করবেন না অমলা!
হিংসের নিশ্বাসটা ত্যাগ করে আস্তে ঘরে এসে ঢুকল ইলা।
আর সঙ্গে সঙ্গে আর একবার মনে হল তার এই সুখস্বর্গ থেকে স্খলিত হয়ে পড়েছে সে। এই জমজমাট মজলিশের মাঝখানে কোনোদিন আর এসে বসতে পারবে না।
ইলা দুঃখী। ইলা নির্বোধ।
.
ওকে দেখেই দিদি হইহই করে উঠল। এতক্ষণে আসা হল মেয়ের! কোথায় থাকিস সন্ধে পার করে?
ওই তো, অমলা বলে ওঠেন, রোজ সেই ন্যাশনাল লাইব্রেরি। কী যে এক রিসার্চ ধরল। চেহারা হয়েছে দেখ না! সেই ভর দুপুরে বেরিয়ে—নিসনি তো ছাতা!
ছাতা।
এতক্ষণে মনে পড়ল ইলার, ছাতা বলে একটা বস্তু ছিল তার কাছে। ছিল, এখন আর নেই। কে জানে কোথায় পড়ে আছে। অতএব একটু হাসল। দিদি বলল, এখন আর দেরি করে লাভ নেই, উঠছিলাম। এই চটপটই বলি—একটি ছেলের ফটো এনেছি, দেখ দিকি কিরকম লাগছে? পছন্দ অপছন্দ খুলে বলিস বাপু। তোর জামাইবাবুর আবার অনেক ঢং কি না। বলেন, আগে ছোটোশালী পাত্রের চেহারাটা অ্যাপ্রুভ করুক, তারপর কথা পাড়া যাবে।
ইলার মাথা থেকে পা অবধি একটা বিদ্যুৎ-প্রবাহ বহে যায়।
ছেলের ফটো!
বিয়ের তোড়জোড়! হঠাৎ আজই!
এটাই কি তাহলে এদের শাস্তির ধরন নাকি? ফাঁস হয়ে গেছে ইলার গোপন তথ্য, সেটা নিজেরা জেরা না করে ইলার মুখ থেকেই বার করতে চায়? নইলে আজই কেন? বুক কেঁপে ওঠে ইলার, তবু মুখে হারে না। বলে জামাইবাবুর বিবেচনার শেষ নেই। তবে বিবেচনাটা মাঠে মারা গেল। আমি ওই সব পাত্ৰাপাত্রের মধ্যে নেই।
ইলার বাবা ছিলেন না ঘরে, মা ছিলেন। বলে উঠলেন বেশ একটু ঝঙ্কার দিয়েই। তা থাকবে কেন? দুপুর রোদ্দুরে টো টো করে ঘুরে শুধু বস্তা বস্তা বই গিলবে।…
মা হঠাৎ আজকেই দুপুর রোদ্দুরের কথা তুললেন। অথচ প্রায়ই তো যায় ইলা।
নির্ঘাত।
নির্ঘাত।
ওঁরা কিন্তু আর বেশি বললেন না।
ইলার দিদি নীলা বলল, যথেষ্ট আদিখ্যেতা হয়েছে, রাখ তুলে। ফটোটা নিয়ে যা, ঘরে রাখ গে, নির্জনে বসে দেখগে যা।
হেমন্ত বলে, আর সেই যে ছেলের গুণাবলী লিপিবদ্ধ করে এনেছিলে, সেটাও দিয়ে দাও শালীকে। এক সঙ্গে রূপ-গুণ দুইয়েরই বিচার হয়ে যাক।
হুঁ, তোমার যত অসভ্যতা! নীলা বলে, ওটা বাবাকে দেখাব বলে নিয়ে এসেছি–
আহা বুঝলাম! কিন্তু যে-মহিলা বিয়েটা করবেন তাকে আগে দেখানোই যুক্তিসঙ্গত।
তা, যুক্তিসঙ্গত কাজই করে নীলা। ইলার শোবার ঘরের টেবিলে ছবিটা আর লেখাটা রেখে দিয়ে আসে।
লজ্জাশীলা এখন লজ্জা করছেন, একা ঘরে নিবিষ্ট হয়ে দেখবেন।
ছবি হেমন্তর অফিসের এক সহকর্মীর ভাইপোর। সম্প্রতি ওদেশ থেকে ঘুরে এসেছে, এদেশ থেকে যথারীতি শিক্ষাদীক্ষা শেষ করে।
ইঞ্জিনিয়ার ছেলে, ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আর চেহারাখানা দেখুক ইলা।
রঙ অবিশ্যি ফরসা নয় বলে গেছে নীলা। সঙ্গে সঙ্গে এও বলেছে, পুরুষ-মানুষের ফরসা রঙ একটা কুদৃশ্য।
হেমন্তর রঙ ফরসা।
তাই এই ধারালো কটাক্ষ নীলার।
দুপুর রোদ্দুর থেকে পরা শাড়ি-ব্লাউজ বদলাতে ইচ্ছে করছিল ইলার, কিন্তু কী যে এক লজ্জা এল! মনে হল, মা হয়তো ভাববেন মেয়ে ওই ছবিটা দেখবে বলেই শাড়ি বদলানোর ছুতো করে ঘরে ঢুকল।
অথচ এই আজই ইলার বিয়ের এই তোড়জোড় দেখে তো হাসিই পাবার কথা।
বারবার ইচ্ছে হল ইলার, মনে মনে খুব হাসে। হাসে এঁদের এই গতানুগতিক প্রথার পথ ধরে মেয়ে পারের চেষ্টা দেখে, মেয়ে যে ইতিমধ্যে ডানা ঝাঁপটে উড়ে গেছে, একথা ভেবে হাসে, কিন্তু পারে না।
বরং ভয়ানক যেন একটা অভিমান আর আক্রোশ আসে। বলতে ইচ্ছে করে, এতদিনে টনক নড়ল তোমাদের? কটা দিন আগে হলেও হয়তো এমন করে ঝাঁপিয়ে পড়তাম না।
কটা দিন কেন, কাল, গত কাল রাত্রেও যদি দিদি আসত, হয়তো আপাতত পিছিয়ে রাখতাম সম্বুদ্ধকে।
আজ, আজ আসার বাসনা হল দিদির।
তারপর হঠাৎ খেয়াল হল এই চিন্তাগুলো সম্বুদ্ধর প্রতি তার নিষ্ঠার পরিপন্থী।
ছি ছি, এসব কি ভাবছে সে।
বরং ভাবা উচিত, ভাগ্যিস বাবা-মা এর আগে মেয়ের বিয়ের চিন্তা করতে বসে যাননি। তাহলে হয়তো লড়াইয়ের মুখে পড়তে হত।
কোথাকার কে এক ইঞ্জিনিয়ার—তার ছবি দেখতে আমার দায় পড়ে গেছে।
শাড়ি বদলাতে গেল খেতে বসার আগে। দিদি চলে গেছে তখন।
তাড়াতাড়ি চলে এল, কিছুতেই না মা ভাবতে পারেন ছবিটা দেখছে ইলা।
খিদের নাম ছিল না, তবু খাবে না বলতে অস্বস্তি। যদি মা প্রশ্ন করেন, খিদে নেই কেন? কোথাও কিছু খেয়ে এলি বুঝি? তাই খেতে বসা।
বিয়ে করে বেরিয়ে বিয়ে হওয়া বিয়ে হওয়া ভাব মনে আসেনি, এল এখন। মায়ের সঙ্গে খেতে বসে।
ঠিক বিয়ে হয়ে যাওয়ারই যে অনুভূতি তাও নয়, তবু কিছু যেন একটা হয়ে যাওয়া। কেন আজ সকালে যে-ইলা মায়ের সঙ্গে খেতে বসেছিল, সে-ইলা নয় সে। এখনকার এই ইলা, অন্য ইলা, আর একজন ইলা।