প্রতিদিনের চেহারায় নতুন কি রঙ লাগল?
তারপর ভাবল, ছি ছি! লুকোচুরি করে আবার বিয়ে! নাঃ, আজই খুলে বলব। যা থাকে কপালে। মায়ের কাছে হয়তো পারব না, দিদির কাছে বলব।
তারপর অকারণেই নিজেকে ভারী দুঃখী মনে হল ইলার। যেন কে ওকে খুব বড়ো ঠকানো ঠকিয়েছে।
ওই, ওই লোকটা। ভালোমানুষের মতো বসে আছে এখন।
ওই তো বিয়ে বিয়ে করে এত অস্থির করেছে।
অবশ্য তার দিকে যুক্তি এই—তুমি যখন বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত অপাপবিদ্ধা থাকতে চাও, পৃথিবীর ধূলি-মালিন্যের ছায়া দেখলে শিউরে ওঠ, তখন, বিয়েটার জন্যে ব্যস্ত হওয়া ছাড়া উপায় কি আমার?
তা কই? বিয়ে হলেই বা কী লাভের আশা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে?
আসল কথা, রাজপথ ছেড়ে গলি রাস্তা ধরলে হবেই অসুবিধে।
বিয়ে। বিয়ে না ছাই। মনে মনে ভাবতে থাকে ইলা, একে আবার বিয়ে বলে। সকাল থেকে সাতবার খেয়ে, নিত্যি-পরা একটা শাড়ি পড়ে নিজে নিজে এলাম আমি বিয়ে করতে! ছিঃ! জীবনের এই পরম শুভদিনে, মা-বাপের সঙ্গে পঞ্চাশ গণ্ডা মিথ্যে কথা বলতে হচ্ছে আমায়। আর—আর স্বামীর কাছে প্রথম আত্মনিবেদনের রাত্রিটি আসবে অবৈধ মিলনের আতঙ্কিত কুৎসিত চেহারা নিয়ে।
বারে বারেই চোখে জল আসে ইলার।
.
গল্পে মন বসে না, পরামর্শে মন বসে না। ইলা বলে, আমি যাই এবার।
আমরা ঠিক করেছিলাম চারজনে একটা সিনেমা দেখে তবে—
না-না, মা-র কাছে ধরা পড়ে যাব।
সম্বুদ্ধ রাগ করে। কিন্তু বলতে পারে না,–পড় ধরা, আমি আছি।
ও থাকবে। পরে থাকবে।
যখন মাইশোরের চাকরিটার তারিখ আসবে, এখানের কাজের তারিখ শেষ হবে। তখন সম্বুদ্ধ ইলার মা-বাপের নাকের সামনে বিয়ের এই দলিলটা ধরে দিয়ে, তাদের মেয়েটাকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাবে। এই পরিকল্পনা সম্বুদ্ধর। নিজের বাড়ির সামান্যতম সাহায্যমাত্র নেবে না। কেউ যেন বলতে না পারে ঠাকুরপোর বিয়ে দিলাম আমরা।
.
দিদির বাড়ি ইলাদের বাড়ির কাছেই।
ইলা ভেবেছিল আগে দিদির বাড়ি নেমে দিদির কাছে অপরাধ ব্যক্ত করে ফেলবে।
হয়ে গেছে বিয়ে, আর তো লাগিয়ে দিয়ে তাদের জীবন-তরণীকে বিশবাঁও জলে ঠেলে দিতে পারবে না দিদি-জামাইবাবু।
বলবে। না বলে থাকতে পারবে না।
এতখানি ভার বহন করে ঘুরে বেড়ানো বড়ো কঠিন। কিন্তু হল না।
শুনল দিদিরা ও-বাড়িতেই গেছে।
বলল দিদির বাড়ির চাকর।
শুনে হঠাৎ পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিথর হয়ে এল ইলার। কেন! কেন হঠাৎ?
এ-ঘটনা যে সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন ঘটে, সন্ধ্যাবেলা যে দিদি বাপের বাড়ি, আর জামাইবাবু শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বসে থাকে, সে-কথা মনে পড়ল না ইলার। ওর মনে হল সব বোধ হয় ফাস হয়ে গেছে।
আর ওঁরা সবাই একত্রিত হয়ে বোধ হয় ইলার জন্যে ফাঁসি-কাঠের ব্যবস্থা করছেন।
সম্বুদ্ধ যে ওকে আশ্বাস দিয়েছিল, আইনত তোমায় কিছু করতে পারবেন না ওঁরা, তুমি নাবালিকা নও। বড়োজোর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে পারেন। তা সেও লোকে পারে না। কেলেঙ্কারির ভয় আছে। লোকলজ্জার ভয় আছে। ওইখানেই জব্দ গার্জেনরা—সে আশ্বাসও কাজে লাগছে না।
পালাবে? কিন্তু কোথায়?
কে বরণডালা নিয়ে বসে আছে ইলার জন্যে?
আস্তে আস্তে বাড়ি এল।
বাইরে থেকে জামাইবাবুর দরাজ গলার হাসি শুনতে পেল।
যাক, তবে পরিস্থিতি খুব খারাপ নয়। বোধ হয় ফঁস হয়ে যায়নি।
স্বস্তিবোধ করে এগিয়ে আসে, আর আবার সেই হাসির আওয়াজ যেন বসবার ঘরটার ছাদ ভেদ করে। ওই রকম আমুদে মানুষ হেমন্ত। দরাজ হাসি, দরাজ গলা, প্রচুর খাওয়া, প্রচুর স্বাস্থ্য। জামাইবাবুকে ইলার খুব ভালো লাগে।
.
কিন্তু আজ হঠাৎ জামাইবাবুর ওপর খুব একটা হিংসে হল ইলার।
শ্বশুরবাড়িতে এসে দিব্যি জমিয়ে বসেছেন ভদ্রলোক। প্রায় রোজই আসেন, তবু মায়ের জামাই-আদরের কমতি নেই।
জামাতা না দেবতা!
অথচ ইলার বর এই আদরের কণিকাপ্রসাদও পাবে না। ইলার বর কোনোদিন এ-বাড়িতে এমন জমিয়ে বসে দরাজ গলায় হাসতে পাবে না।
অথচ সম্বুদ্ধ কম বাক্যবাগীশ নয়। কথায় তার ছুরির ধার।
মা বলেন, আমার বড়ো জামাইটি যেমন, ছোটোটি যদি তেমন হয় তবেই আমোদ। তা এমনটি কি আর হবে? হয়তো গোমড়ামুখোই হবে।
মা-র সেই ছোটো জামাইয়ের মুখটা কেমন, তাই দেখবেন না মা।
এ-বাড়িতে কি কোনোদিন আসেনি সম্বুদ্ধ?
এসেছে।
বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেছে, ইলার ছোটো ভাই কি চাকরের সঙ্গে কথা বলেছে। কথা আর কি, ইলাকে ডেকে দেওয়ার কথা। একদিন ইলার বাবা দোতলার বারান্দা থেকে দেখেছিলেন। বলেছিলেন, নীচে ছেলেটি কে সেই থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে?
ইলা বলেছিল, ওঁর ভাগ্নীর সঙ্গে পড়েছিলাম আমি, লাইব্রেরির একখানা বই ছিল ওঁর কাছে—
তাড়াতাড়ি নেমে গিয়েছিল ইলা এই ফাঁকা উত্তরটা দিয়ে।
পরে বলেছিল সম্বুদ্ধকে কিরকম প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব তা বল? আমাদের ক্লাশের নন্দিতা বলে একটা মেয়ে বলেছিল, ওই যে কবিতা-টবিতা লেখেন সম্বুদ্ধ ঘোষ, উনি আমার সম্পর্কে মামা হন। কাজে লাগিয়ে দিলাম কথাটা। তা ছাড়া লাইব্রেরির বইটাও দিলাম ঢুকিয়ে।
কিন্তু এত বুদ্ধি প্রকাশ করেই কি পার পেয়েছিল নাকি ইলা? পরে বারবার জেরা করেননি ইলার বাবা? ছেলেটি কে? কোথায় থাকে? নাম কি? ইত্যাদি।
এমনভাবে বলেছেন, যেন জেরা নয়, শুধু গল্প করা।
নামটা শুনে ভুরুটা একবার কুঁচকে ছিলেন। কিন্তু এ-কথাটা তো বলতে পারেননি, ঘোষেদের ছেলের সঙ্গে মেশবার এত কি দরকার তোমার?