.
আজ সেই দিন। চোরের পথ ধরে বিয়ে করতে যাবে ওরা। বিকেল চারটের সময় প্রতীক্ষা করবে সম্বুদ্ধ। আর ইলার এখন কিনা ইচ্ছে দুপুরের নির্জনতায় জানলা-দরজা বন্ধ করে নরম ছায়াময় ঘরে একটু গা ছেড়ে দেওয়া ঘুম দেয়।
তবু সে-ইচ্ছেকে বাদ দিয়ে উঠতেই হল ইলাকে। চুল বাঁধল, প্রসাধনের টুকিটাকি সেরে নিল, তারপর নিত্যদিনের সাজ সেজে বেরিয়ে পড়ল পৌনে চারটের চড়া রোদ্দুরে।
প্রায়ই এ-সময় ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে যায় ইলা, কাজেই ইলার মা অমলা প্রশ্ন করলেন না। শুধু বললেন, উঃ, যা রোদ! একটা ছাতা নিলে পারতিস। বলে পাশ ফিরে শুলেন।
ছাতা ইলা নেয় না। কোনোদিনই নেয় না, তবু অমলা রোজই বলেন। আর রোজই ইলা সে-উপদেশ উড়িয়ে দিয়ে চলে যায়। ভাবে, বয়েস হলেই মানুষের উপদেশ দেওয়ার ইচ্ছেটা এমন বাড়ে কেন! কিন্তু আজ তা ভাবল না।
আজ মায়ের ওই উপদেশবাণীটুকুর মধ্যেই যেন অবাধ একটা স্নেহের স্পর্শ পেল ইলা, আর চোখের কোলে এক ঝলক জল এসে গেল।
অকৃতজ্ঞ! অকৃতজ্ঞ।
ইলার মতো এমন অকৃতজ্ঞ মেয়ে আর কটা আছে? যদিও সম্বুদ্ধ অনেক উদাহরণ দেখিয়েছে তাকে এমন গোপন বিবাহের, এবং পরে আবার সব ঠিক হয়ে গেছে, সে-উদাহরণও দেখিয়েছে, তবু ইলার ওই কথাই মনে এল। আর সত্যিই ঘরের কোণ থেকে ছাতাটা টেনে বের করে ঠুকে ধুলো ঝেড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
খানিক পরে, চোখের জল শুকোলে মনে পড়ল সম্বুদ্ধ নিশ্চয় হাসবে। বলবে, হঠাৎ? ছাতার আড়ালে আত্মগোপন নাকি?
উত্তরটা প্রস্তুত করে রাখল ইলা। বলবে, তা নয়। রোদে ঘেমে কালো হয়ে যাই, এ ইচ্ছে নেই আজ।
ওদের প্রোগ্রামে আছে, রেজিস্ট্রি অফিস থেকে বেরিয়ে কোথাও ঢুকবে দুজনে একসঙ্গে খেতে। এই।
এর চাইতে বেশি কোনো অনুষ্ঠান আর কি সম্ভব? কিন্তু শুভরাত্রিটা?
ফুলশয্যার সেই অনুষ্ঠানটা? সেও কি শূন্য একটা সন্ধ্যার যন্ত্রণার মধ্যেই সমাপ্ত হবে? কোনো কিছু উপায় নেই?
.
খেতে ঢুকল ওরা দুজন, আর উইটনেস্ দুজন। অসীম আর কুমকুম। দুজনেই এদের দুজনেরই বন্ধু।
আর ওরা নিজেরাও পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠেছে যেন ক্রমশ। তবে ওদের আর এদের মতো লুকোচুরির সুড়ঙ্গ পথ ধরতে হবে না। ওদের দুজনেরই প্রগতিশীল বাড়ি।
তা, ওরাই উপায়টা বাতলাল। বলল, একটা নেমন্তন্নর ব্যাপার ঘটানো ছাড়া উপায় নেই, এবং সেটা যাতে বেশ খানিকটা সময় আহরণ করতে পারে।
কুমকুম বলল, বেশ, আমি নেমন্তন্ন করছি গিয়ে। বলব তোর মাকে, বাড়ি থেকে আমরা সবাই আমাদের চন্দননগরের বাড়িতে যাচ্ছি, ইলাও চলুক আমার সঙ্গে। ফিরতে রাত হয়ে গেলে ভাববেন না। তারপর অবশ্য কোনো আকস্মিক অনর্থপাতে রাত হয়ে যাবে। আমি বাড়ি থেকে ফোন করে দেব, ইলা আজ এখানেই–
ইলা রাগ করে বলে, আমাদের বাড়িতে ফোন কোথায়?… আর সে তুই যতই খবর দিস, বাবা ঠিক এসে হাজির হবেন। রাত দুটো বাজলেও।
বেশ, তবে বলব চন্দননগরে থাকা হবে একটা রাত।
ইলা মাথা নেড়ে বলল, তাহলে তো আসতেই মত দেবেন না।
সম্বুদ্ধ বলে, ঠিক আছে। চল, এখনই গিয়ে দুজনে প্রণাম করে আসি, সব গোল মিটে যাক।
ইলা শিউরে উঠে বলল, ওরে বাবা! সে অসম্ভব।
তবে নিরীহর মতো যাবি চন্দননগরে, রাতে ফিরবি না। আমি সকালে তোকে এনে দেব সঙ্গে করে, বলব রাতে ভীষণ জ্বরে ধরেছিল–
হেসে গড়িয়ে পড়ে কুমকুম।
কিন্তু ইলা এই হাসি-তামাশার মধ্যে নিজেকে পৌঁছতে পারে না। ইলার বুকের মধ্যে ভয়ানক একটা যন্ত্রণা ধাক্কা দিচ্ছে। ইলা যেন এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচে।
এদের কাউকেই এখন ভালো লাগছে না। অসীম কুমকুম কাউকে না।
মনে হচ্ছে এতদিন ধরে ওরাই যেন তাকে প্ররোচনা দিয়ে দিয়ে একটা বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
সম্বুদ্ধও। সম্বুদ্ধকেও যেন এখন ভয়ের মতো মনে হচ্ছে।
তাই ইলা কুমকুমের হাসির পর নীরস স্বরে বলে, ও-সব কথা রাখ, ও হবে না। রাত দশটা সাড়ে-দশটার মধ্যে যাতে ফেরা যায় সে-রকম কোনো ব্যবস্থা–
সম্বুদ্ধও প্রায় রেগে ওঠে।
সম্বুদ্ধ বলে, তা তোমার যখন এত অসুবিধে, তখন থাক না হয়।
ইলা ভ্রভঙ্গি করে। বলে, তা, তোমার যদি খুব সুবিধে থাকে তো চল না তোমাদের বাড়িতেই। তোমার বউদিরা ফুলের বিছানা পেতে রাখুন, বরণডালা সাজিয়ে বসে থাকুন। আমি বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে গিয়ে উঠছি।
সেটা হবে না।
এইটাই হচ্ছে কথা। অগাধ লোক সম্বুদ্ধদের বাড়িতে। আর তারা নাকি মারাত্মক রকমের সেকেলেপন্থী। এখনও ব্রাহ্মণ-কায়স্থে বিয়ে অনুমোদন করে না। সম্বুদ্ধ যে এই বিয়েটা করেছে, সে শুধু শীঘ্রই একটা ভালো পোস্ট পেয়ে মাইশোরে চলে যেতে পারবে বলে। যতদিন না যাচ্ছে, ততদিন যা হোক করে–
শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, শুধু কুমকুমের বাড়িতে নেমন্তন্নর ছুতো করে রাত দশটা পর্যন্ত কোনো একটা হোটেলে গিয়ে
একবার অন্তত একত্র রাত্রিবাস না হলে বিয়েটা মঞ্জুর হবে কি করে?
কুমকুম হেসেই অস্থির, কী ভীতু তুই বাবা! বিয়ে হয়ে গেল, তবু এখনও এত ভয়?
চুপি চুপি কানে কানে বলল ইলার। বলল, এখনও কি পরপুরুষ বলে মনে হচ্ছে নাকি রে? কৌমার্য-ভঙ্গের অপরাধে কেস করবি?
ইলা আরক্ত মুখে বলল, থাম। অসভ্যতা করিসনে। আর মনে মনে বলতে লাগল, সে-কথা তো অস্বীকার করতে পারছি না। বিয়ে হয়ে গেছে, এ-অনুভূতি কই আমার?