তবু চলতে লাগল প্রহসনের আয়োজন।
পাকা দলিলটা নিতান্তই কাঁচা চেহারা নিয়ে কাচুমাচু হয়ে পড়ে রইল প্রহসনের নায়ক-নায়িকার গোপন ভাণ্ডারে।
পাঁচজনে জানল শুধু প্রেম।
চমকাবার কিছু নেই, চমকালও না কেউ। বড়োজোর নিমন্ত্রণপত্রে পাত্রের নাম শ্রীমান সম্বুদ্ধ ঘোষ দেখে ইলার বাবার ব্রাহ্মণ আত্মীয়রা একটু মুখ টিপে হাসল মাত্র।
নিমন্ত্রণে আসবে না, এ-কথা ভাবতেও পারল না কেউ।
ভাববে কোন্ সাহসে? কার ঘরের দেয়ালে সিঁধ কাটা হচ্ছে, অথবা হবে, কে বলতে পারে?
.
সম্বুদ্ধর কাছে পরদিন গিয়েছিল ইলা, গম্ভীর মুখে বলেছিল, ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছি, যাও, গিয়ে বল গে। ন্যাকামী করবে না, ঔদ্ধত্য করবে না, আর একবার বিয়ে দিতে চাইলে আপত্তি করবে না—বুঝলে?
আর একবার বিয়ে!
ইলা আরও গম্ভীর হয়, হ্যাঁ। চিরাচরিত প্রথায় যথারীতি বিয়ে। সেটাই করতে হবে। যেতে হবে আমার জন্যে টোপর পরে জাঁতি হাতে নিয়ে। এতেও যদি বল বাড়িতে জানতে পারবে, তাহলে আমার সঙ্গে এই শেষ।
সম্বুদ্ধ বিদ্রূপ করে বলে, তারপর? যথারীতি বিয়েটা সেই ভাগ্যবান ইন্দ্রনীল মুখার্জীর সঙ্গে নাকি?
থামো! তার নাম মুখে এনো না তুমি।
উঃ, মেজাজ যে সপ্তমে। যথারীতি বিয়েতে আমার আর আপত্তি কি? বরং তো লাভই। শ্বশুরের মেয়েটাই পাচ্ছিলাম শুধু শ্বশুরের দেওয়া যৌতুক, শ্বশুরবাড়ির আদর, এগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলাম। সেগুলো উপরি পাওনা হচ্ছে। বাবাকে বল, ঘড়িটা যেন ভালো কেনেন।
হাসতে তোমার লজ্জা করছে না?
কী মুশকিল, লজ্জা করবে কেন? বরং খাট-বিছানা আলমারি-আয়না সব কিছুর আশাই তো করছি সাগ্রহে।
ইলা তীব্রস্বরে বলে, পাবে। সব কিছুই পাবে সম্বুদ্ধ ঘোষের জন্যে হোক না হোক, মা-র ছোটো জামাইয়ের জন্যে সবই গেছে গড়তে।
তা গেছে।
অনুষ্ঠানের ত্রুটি হচ্ছে না সত্যিই।
খাতার মাঝখানের বিদীর্ণ অধ্যায়ের পৃষ্ঠাটা উলটে ফেলে নতুন অধ্যায়ে চোখ ফেলা হয়েছে।
নীলা রাগ ভুলে মহোৎসাহে বিয়ের বাজার করে বেড়াচ্ছে, অমলা নতুন নতুন ফর্দ লিখছেন।
ইলার বাবা সেকরার দোকানে আর ফার্নিচারের দোকানে হাঁটাহাঁটি করছেন, হাঁটাহাঁটি করছেন। বরের বাড়ি।
সম্বুদ্ধর দাদা-বউদি এখন আর নিরপেক্ষ নেই, বিয়ের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন হয়েছেন। আর সম্বুদ্ধকেও এই সেকেলে বাড়ির সেকেলেপনার মধ্যেই বেশ মিশে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
গায়ে-হলুদ দিতে বসে মামাতো বউদি যখন দুগালে হলুদ লেপে দিল, তখন সম্বুদ্ধ ছিটকে বেরিয়ে গেল না, শুধু একটু কোপ দেখাল। দধিমঙ্গলের চিঁড়ে-দই নিয়ে ওরা যখন হাসাহাসি করল, সম্বুদ্ধ হাসতে হাসতে ওদের মাথায় মাখিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেল।
এই সব দিদি-বউদিদের যে সম্বুদ্ধ মানুষ বলে গণ্যই করত না, সেটা এখন অন্তত মনে পড়ল না।
আবার বড়োবউদি তার মস্ত বড়ো আইবুড়ো মেয়েকে বরযাত্রী পাঠাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না, দাদা উপবাস করে নান্দীমুখ করতে আপত্তি করলেন না।
সকলেরই যেন মনোভাব, হাতছাড়াই তো হয়ে গিয়েছিল, সেই হাতছাড়া বস্তু আবার যদি হাতে ধরা দিয়েছে তো আমোদটা ছাড়ি কেন?
.
আর ইলা?
সে-ও কি সম্বুদ্ধর মতোই লজ্জার বালাই ত্যাগ করে উৎসবে মাতে? দিদির সঙ্গে মার্কেটিং করতে যায়? মায়ের সঙ্গে গহনার প্যাটার্ন নিয়ে আলোচনা করে?
নাঃ, ইলা একেবারে চুপচাপ হয়ে গেছে।
ইলার এই স্তিমিত মূর্তি দেখে ইলার মাকে ইচ্ছার অধিক উৎসাহ দেখাতে হয়, ইলার বাবাকে মৌনব্রত ভাঙতে হয়। আর ইলার জামাইবাবুকে নতুন নতুন ঠাট্টা আমদানী করতে হয়।
জলি মেয়েটা মনমরা হয়ে বেড়াচ্ছে, এও তো দেখা যায় না।
.
অবশেষে আসে সেই দিন।
মহলার শেষে অভিনয়ের।
বিয়েতে কোনো অনুষ্ঠান হল না, এ-আক্ষেপ আর থাকে না ইলার।
সেই একটা রোদ্দুরের দুপুরে যত কিছু আক্ষেপ জমে উঠেছিল তার, সব বুঝি ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন করে দেবার পণ করেছে ইলার সংসার, ইলার পরিজন।
প্রদীপ জ্বেলে নতুন বেনারসী শাড়ি পরে আইবুড়ো-ভাত খায় ইলা, কোরা লালপাড় শাড়ি পরে গায়ে-হলুদ নেয়। কলাতলায় দাঁড়িয়ে সাত এয়োর মঙ্গলকামনা জড়ানো হলুদমাখা সুতো জড়ায় হাতে, অধিবাসের পিড়িতে গিয়ে ঘাম-ঘাম হলুদ-হলুদ মুখ নিয়ে, যে পিঁড়িতে অনেক শিল্পকলার নমুনা দেগে রেখেছে অমলার এক ভাইঝি।
ইলার বাবা মেয়েকে পাশে বসিয়ে অধিবাস দ্রব্যের কল্যাণস্পর্শে পবিত্র আর মহান করে তোলেন তাকে। পবিত্র আর পরিচিত অনুষ্ঠানগুলি অনুষ্ঠিত হতে থাকে পরপর।
সন্ধ্যায় কনে-চন্দন পরে ইলা, পরে ফুলের মালা। পরে ওর অনেকদিনের পছন্দর রুপোলী তারাফুল দেওয়া লাল বেনারসী শাড়ি। মোনামুনি ভাসিয়ে বেঁধে দেওয়া হয় ইলার গলায়, ইলা স্পন্দিত রুপোলী বুক নিয়ে চণ্ডীপুঁথি কোলে নিয়ে বসে থাকে অনেকগুলো সুখী দম্পতির নাম লেখা আর একখানা ভারী পিঁড়িতে। এই পিড়ি নিয়েই সাতপাক ঘোরাবে সবাই ইলাকে নিয়ে বরকে ঘিরে ঘিরে।…
শাঁখ বাজে একসঙ্গে একজোড়া, নারীকণ্ঠ বাজে উলুধ্বনি হয়ে, সানাই বাজে করুণ সুরে। আলো জ্বলে, বাড়ি সাজানো হয়, ফুলের গন্ধে আর সেন্টের গন্ধে বাতাস ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
নিমন্ত্রিত-নিমন্ত্রিতারা সন্ধ্যার আগে থেকেই দলে দলে আসতে শুরু করেন, তাদের উদ্দাম কলকাকলী আর শাঁখ-উলুর শব্দ একত্রিত হয়ে উৎসব সমারোহের চেহারা আনে। সামিয়ানা-খাটানো ছাদ থেকে ভেসে আসে চপ আর লুচি ভাজার গন্ধ।..