হেমন্ত হাসে।
বলে, কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে প্রেম বস্তুটার যে মহা আড়ি, এমন কথাও নেই।
সে কথা বলছি না, নীলা ক্রুদ্ধ গলায় বলে আমি বলছি লুকোচুরি করবে কেন? প্রেমে পড়েছিস পড়েছিস, সাহসের সঙ্গে এসে স্বীকার কর। মানুষ তো ইঁদুর ছুঁচো নয় যে গলি খুঁজে খুঁজে আত্মগোপন করবে?
হেমন্ত হাসে।
বলে, তা অবশ্য ঠিক বলেছ। তবে কি জানো, দেশটার যে আকাশে-বাতাসে ভীরুতা। ভয়..ভয়…ভয়ই গ্রাস করে রেখেছে সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তিকে। আগে ছিল বাপের ভয়, সমাজের ভয়, লোকলজ্জার ভয়, এখন সেগুলো ঘুচেছে, জায়গায় এসে হাজির হয়েছে অভাবে পড়বার ভয়, অসুবিধেয় পড়বার ভয়, ঝঞ্জাট পোহাবার ভয়।…এতেই কণ্টকিত। অবিশ্যি এক্ষেত্রে আরও একটা ভয় আছে, সেটা হচ্ছে গুরুজনের স্নেহ হারাবার ভয়। সেই ভয়ের থেকেই–
তা আর নয়–
নীলা প্রায় ধমকে ওঠে, বকো না। গুরুজন ভেবে তো অস্থির বাছারা। তাদের স্নেহের ধার ভারী ধারছে!
হেমন্ত গম্ভীর হয়।
বলে, না নীলা, সত্যি! সেটাই বোধ করি প্রধান কারণ। ঊধ্বর্তনেরা যেদিন অধস্তনদের প্রেমে পড়ায় আঘাত পাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করবে, ঘটনাটাকে সহজ আর স্বাভাবিকতম ব্যাপার বলে গ্রহণ করতে শিখবে, সেদিন থেকেই লুকোচুরি বন্ধ হবে।
হবে! বলেছে তোমায়।
নীলা হেমন্তর কথা মানতে রাজী নয়।
হেমন্ত হেসে ফেলে বলে, একটা কাল ছিল জান অবশ্যই, যখন ছেলে তার বিবাহিতা স্ত্রীকে ভালোবাসলেও গুরুজনেরা আহত হতেন। ছেলে যদি তাঁদের অনুমতি ব্যতীত স্ত্রীকে একখানা শাড়ি কি সামান্যতম কিছু উপহার দিত, তাহলে অপমানের আঘাতে জর্জরিত হতেন তারা। সে-অবস্থা এখন আর নেই, এটাও থাকবে না। শালী যে রেজিস্ট্রিটা করে ফেলেছে, এর জন্যে আমি ওর বুদ্ধির তারিফ করি। যাক, এবার একটা ফর-শো বিয়ে লাগিয়ে দেওয়া যাক।
নীলা ভুরু কোচকায়।
ফর শশা বিয়ে লাগিয়ে দেওয়া যাক?
নিশ্চয়।
রুচি হবে?
হবে না কেন? কত অরুচিকর ব্যাপারকে মাথায় তুলে নিতে হচ্ছে রাতদিন, এ তো বরং আহ্লাদের, মজার।
নীলা ঠিকরে ওঠে।
নীলা ক্রুদ্ধ গলায় বলে, বাবা আবার ঘরের কড়ি খরচ করে বিয়ে দেবেন ওর?
হেমন্ত ওর রাগ দেখে হো হো করে হাসে।
কেন নয়? ইতর জনের পাওনাটা মাঠে মারা যাবে নাকি?
কেউ আসবে না এ-বিয়েতে।
সবাই আসবে।
এত ইতরজন কেউ নেই আমাদের আত্মীয়দের মধ্যে।
আরে, ওটা তো কথার কথা। মিত্রজনই না হয় বলা যাক। তবে নেমন্তন্নটা মাঠে মারা যেতে দেখলেই বরং অখুশি হবে তারা।
.
না, মাঠে মারা যাওয়ার রেওয়াজ আর নেই। ছেলেমেয়ের নির্বুদ্ধিতা, ছেলেমেয়ের কাণ্ডজ্ঞান শূন্যতা, ছেলেমেয়ের অসাবধানতা, সব কিছুকে ঢেকে নিয়ে, ঘটনাটার একটা সভ্য চেহারা তো দিতে হবে! সভ্য আর সুন্দর। সেটাই সামাজিক মানুষের দায়।
সম্বুদ্ধ ঠিকই বলত, ওইখানেই গার্জেনরা জব্দ।
জব্দ বইকি! শুধু মমতার কাছে নয়, এই সভ্যতা শোভনতার কাছেই জব্দ। ঘরের মেয়েটা কোনো কিছু না হঠাৎ একদিন আর একটা ঘরে ঘর করতে শুরু করে দিল, এই কটু দৃশ্যটার হাত এড়াবার জন্যেই বিবাহিত দম্পতিকে নিয়ে আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে বসেন তাঁরা। হাস্যকর ছেলেমানুষী, তবু তাই দিয়েই সম্রম বজায় রাখা। তা, নায়ক-নায়িকার অলাভ কিছু নেই এতে। ডবল বিয়ের সুযোগে যথারীতি পাওনাগুলো এসে যায় হাতে।
মা-বাপ ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন, এদের হৃদয়ে সাধ-আহ্লাদও তো থাকে!
চিরদিনের সংস্কারে লালিত আজন্মসঞ্চিত সেই সাধগুলি এই হাস্যকর ছেলেমানুষীর মধ্য দিয়েই বিকশিত হবার পথ পায়।
চির-আদরিণী মেয়েটা, একটু ভুল করে ফেলেছে বলে শূন্য হাতে বিদায় নেবে?
তার যে ভারি শখ ছিল অনেক শাড়ি-গহনার। কবে যেন কার বিয়েতে সোনালী ফুলদার সবুজ বেনারসী দেখে মোহিত হয়েছিল, উচ্ছ্বসিত হয়েছিল কার গলায় যেন সেকেলে গড়নের পুস্পহার দেখে। তার কিছু হবে না? তাছাড়া ছোটোখাটো আরও কত বাসনাই তো ব্যক্ত করে থাকে মেয়েরা, তাদের বস্তুলুব্ধ বাসনাময় হৃদয়ের।
বিয়ের সময় হবে, বিয়ের সময় দেব,—বলে ঠেকিয়ে রাখে মধ্যবিত্ত ঘরের গৃহিণী মা।
সেই ঠেকিয়ে রাখাটা বিধতে থাকে কাটার মতো মায়ের প্রাণে।
বিয়ের সময় তাই মাকে আর ঠেকানো যায় না। তা, সে-বিয়ে যদি প্রহসনও হয়।
.
প্রহসন বইকি—।
তাই বলেছিলেন ইলার বাবা। আর বলেছিলেন, সত্যিই কি প্রয়োজন এই প্রহসনের? অগ্নি নারায়ণ সাক্ষী করে কন্যা-সম্প্রদানের কার্য করতে বসব আমি হেমন্ত? চির-শান্ত, চির-সংযত মানুষটার কণ্ঠে এই জ্বালার সুর শুনে অপ্রতিভ হয়েছিল হেমন্ত। তবু ঘাড় চুলকে বলেছিল, ফার্স কেন বলছেন? ছেলেবুদ্ধিতে একটা বাঁদরামী করে ফেলেছে–
এম-এ পাস করেছে ইলা, একুশ বছর বয়েস হয়ে গিয়েছে ওর হেমন্ত। ছেলেমানুষ বলা মানে মনকে চোখ ঠারা।
তবু দেখুন ছেলেমানুষ ছাড়া আর কি? এমনটা করেছে কেন নইলে?
ইলার বাবা পায়চারি করতে করতে বললেন, আমার এখন কি মনে হচ্ছে জান হেমন্ত, সেই তোমার বন্ধুর ভাইপো, বোধ করি কোথাও থেকে কানাঘুষো কিছু শুনে থাকবে, তাই
অসম্ভব নয়।
সেই ছেলেটিকে যে আমি আপন করতে পেলাম না, এ-দুঃখ আমার চিরকাল থাকবে হেমন্ত।
হেমন্ত স্বভাবগত কৌতুকে বলতে যাচ্ছিল এমন একটি সোনারচাঁদ জামাই থেকেও আপনার দুঃখমোচন হবে না? বলতে পারল না। ওই আহত বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল।