ইন্দ্রনীলের বাড়িতে বলল, পাগল হয়ে গেছে। বলল, মাথাটা আমাদের হাতে করে কাটালি? কি করে বলব এ-কথা?
ইন্দ্রনীল শান্ত গলায় বলল, কি আর বলবে। বল গে তখন বুঝতে পারেনি।
কিন্তু এখনই বা নতুন কি বুঝলি তুই?
কি জানি। কেমন যেন ভালো লাগছে না এখন।
কনের বাপের ওপর কি বাজটা ফেলা হবে, ভেবে দেখেছিস?
ভাবছি তো। কিন্তু মনকে ঠিক করতে পারছি না।
অতএব ঠিক করা বিয়েটাই বেঠিক হল।
বাজ ফেলা হল করেন বাপের মাথায়।
ফেলতে হল হেমন্তকেই।
বজ্রাহত দম্পতির সামনে বসে থাকতে হল মাথা হেঁট করে।
জামাইবাবুর হেটমুণ্ড এই প্রথম দেখল ইলা। তারপর শুনতে পেল জামাইবাবুর বিষণ্ণ গলা।
ছেলের বাড়ির সবাই তো তাজ্জব হয়ে গেছে।—বলছে, ওকে দেখে মনে হচ্ছে কে যেন ওকে মন্ত্ৰাহত করে ফেলেছে। নইলে ইন্দ্রর পক্ষে সম্ভব এমন অসম্ভব অভদ্রতা করা?
না, সম্ভব নয়।
ইন্দ্র বাড়ির সেরা রত্ন। সেই রত্ন নিজের মুখে চুনকালি মেখে ইলাকে রক্ষা করছে চুনকালির হাত থেকে।
কেন? ইলার কে সে?
কেউ নয়, ইলা শুধু তার ভদ্রতার দরজায় হাত পেতেছিল। অথচ সম্বুদ্ধ নিজের গায়ে আঁচটি নিচ্ছে না।
বাড়িতে নিন্দিত হবে বলে, বিয়ের কথা ফাঁস করছে না।
ইলা দাঁতে দাঁত চেপে মঞ্চ থেকে সরে যায়। অমলা ভীত কণ্ঠে বলেন, দেখ বাবা হেমন্ত, মেয়ে আবার এ-অপমানে কি করে বসে।
না, করবে আর কি?
হেমন্ত শুকনো মুখে বিদায় নেয়। শ্বশুরবাড়ি থেকে এই প্রথম।
ইলা নিজের ঘর থেকে টের পায় সব।
ইলার বাবা দালানে পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন আর মাঝে মাঝে অমলাকে বলছেন, দেখ, তুমি মন খারাপ করো না, এ একরকম ভালোই হল, আগেই বোঝা গেল। মানুষ যে কত ছদ্মবেশী হতে পারে, তার নমুনা দেখে অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হল।
অমলা কথা বলেন না, অমলা স্তব্ধ হয়ে ভাবেন, কিন্তু এ ছদ্মবেশের প্রয়োজন কি ছিল তার? কী দরকার ছিল ইলার দিকে অমন আলো-জ্বালা চোখে চাইবার? অমন প্রসন্ন স্মিত হাসি হাসবার?
অমলা ভেবেই নিয়েছিলেন, মুগ্ধ হয়ে ফিরে গেছে সে। হঠাৎ এ কী অদ্ভুত কথা!
মেয়ে পছন্দ হয়নি।
পাত্র-পক্ষের আর সবাই যে-কথা শুনে মাথায় হাত দিয়েছে, সেই কথা উচ্চারণ করেছে সেই পাত্র? অমলা ভাবতে ভাবতে অবশ হয়ে গেলেন।
অমলা আজ রান্না করলেন না।
.
অনেকটা রাত্রে মেয়ের ঘরে ঢুকলেন অমলা, এক গ্লাস দুধ আর দুটো মিষ্টি নিয়ে।
আস্তে বললেন, খেয়ে নে। শরীরটা তেমন ভালো লাগছিল না, আজ আর রান্না করতে পারিনি।
ইলা উঠে বসে।
আস্তে বলে, রমু কি খেল?
ও দুধের সঙ্গে পাঁউরুটি খেয়ে শুয়ে পড়েছে।
বাবা?
আরও আস্তে, আরও সন্তর্পণে উচ্চারণ করে ইলা।
উনিও দুধই গেলেন শুধু। খিদে-তেষ্টা আর নেইও তাঁর। মানুষের দুর্ব্যবহার দেখে পাথর হয়ে গেছেন। কতখানি বিশ্বাস করেছিলেন–
মা!
হঠাৎ একটা আর্ত চিৎকারে মায়ের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইলা।
চাপা তীক্ষ্ণ স্বরে বলে, মানুষ যে কতখানি বিশ্বাসঘাতক হতে পারে তার নমুনা দেখতে অন্য কোথাও যেতে হবে না মা তোমাদের, নমুনা তোমাদের ঘরের মধ্যেই আছে। সেই বিশ্বাসঘাতক, জোচ্চোর দিনে দিনে মাসে মাসে ঠকিয়ে আসছে তোমাদের–
কে? কে? কার কথা বলছিস?
অমলা প্রায় চিৎকার করে ওঠেন, কিসের বিশ্বাস?
সব, সব কিছুর মা! তোমাদের ভালোবাসার, তোমাদের সম্ভ্রমের, তোমাদের সুনামের, তোমাদের বংশের পবিত্রতার। সব কিছুর বিশ্বাস নষ্ট করেছি আমি। আর ছদ্মবেশে তোমাদের মায়া মমতা স্নেহ-ভালোবাসা অন্ন-বস্ত্র সব নিয়ে চলেছি।
অমলা ইলার বিছানার ওপর বসে পড়েন। রুদ্ধকণ্ঠে বলেন, কি বলছিস তুই ইলা?
যা বলছি সব ঠিক মা। এতদিন তোমাকে জানাতে পারিনি, বার বার বলতে গেছি, পারিনি মা। তোমাদের দেওয়া বিয়ে করবার উপায় নেই আমার।
উপায় নেই! উপায় নেই!
অমলা স্তব্ধ হয়ে গিয়ে বলেন, উপায়ের বাইরে চলে গিয়েছিস তুই? বল তবে, খুলে বল কতখানি কালি মাখিয়েছিস আমাদের মুখে।
.
রেজিস্ট্রি করেছে শুধু। অন্য কিছু নয়?
হেমন্ত হাল্কা গলায় বলে ওঠে, এতে তো তোমাদের দুহাত তুলে নাচবার কথা।
নীলা বিরক্তির ঝঙ্কার তোলে, নাচবার কথা?
নিশ্চয়! ভেবে দেখ, এটা না হয়ে অপরটা হলে? তাতেও নিরুপায়তা ছিল। তার ওপর ছিল চুনকালি, এতে তো আর মুখে চুনকালি পড়ছে না।
পড়ছে না?
নো! নো! এ হেন ঘটনা এখন হরদম চলেছে—
আর এই যে ঘোষ না কি একটা হতচ্ছাড়া, এতে মা-বাপের প্রাণ ফেটে যাচ্ছে না?
ফাটবে না, ফাটার কারণ নেই—এটা ভাবলেই সহজ হয়ে আসে। অবশ্য আমি বলছি না খুব একটা সুন্দর কিছু হয়েছে। আগাগোড়া ব্যাপারটাই না ঘটলে ভালো হত। কিন্তু এও ঠিক, আমরাই অবস্থাকে অসুন্দরে পরিণত করি।—অনুমোদন পাবে না, এই ভয়েই এই সব কাণ্ড করে বসে ছেলেমেয়েগুলো।
পাবেই বা কেন? সব প্রেমে পড়াই অনুমোদনযোগ্য? নীলা রেগে রেগে বলে।
আহা, দেবতাটা অন্ধ, এ তো চিরকেলে কথা।
অতএব উচিত হচ্ছে সেই অন্ধের হাতে ভাগ্য সমর্পণ করে না বসে, যারা চোখ-কানওলা তাদের হাতে ভাগ্যটাকে রাখা।
সে তোমার বলা অন্যায়। এই জগতে চরে বেড়াবে অথচ কোথাও কোনোখানে হোঁচট খাবে, এতটা আশা করা যায় না।
নীলা গম্ভীরভাবে বলে, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে হোঁচট খাব, বাড়ি, সংসার, মা-বাপের মুখ ভাবব না, এমনই যদি অবস্থা হয়, তবে আর শিক্ষার মূল্য কি? শিক্ষার সঙ্গে সংযমের কোনো সম্বন্ধ নেই?