বলেছিলাম দিদি।
বলেছিল।
কিন্তু তেমন করে বলেনি, সে-কথা নিজেই জানে ইলা। কোথায় যেন একটা বাসনার কাঁটা ছিল বিঁধে। নইলে সকাল থেকে মনটা এমন উদ্বেলিত হচ্ছিল কেন?
কেন অমন পরিপাটি প্রসাধনে রাজী হয়েছিল? আর কেন লোকটা যখন এল স্পষ্ট সহজ চোখে তাকাতে পারেনি তার দিকে? সে কি শুধুই একটা অস্বাভাবিকতার অস্বস্তি? না, ভালো লাগার সুখ? অথবা ভালো লাগার অসুখ?
আমি জানি না। নীলা বলে, যা বলবার নিজেই জামাইবাবুকে বল গে।
ওরে বাবা, রক্ষে কর।
তবে বল গে যা মাকে, বাবাকে। তবে জেন, তোমার বিয়ের মধ্যে আর নেই আমরা।
হঠাৎ হেসে ফেলে ইলা। বলে আচ্ছা। তারপর চলে আসে।
.
হেমন্ত আসতেই নীলা ফেটে পড়ে।
শুনেছ তোমার শালীর আদিখ্যেতার কথা? এখন বলছে রিসার্চ শেষ না করে বিয়ে করবে না।
হেমন্ত অফিসের পোশাক ছাড়তে ছাড়তে অম্লান গলায় বলে, শালীরা অমন বলে থাকে।
জানি না। এখনকার মেয়েদের বোঝা ভার। কী দরকার তোমার এর মধ্যে থাকবার?
হেমন্ত সহজ পোশাকে সুস্থ হয়ে বলে, কেন মাথা খারাপ করছ? মেয়েরা অমন দর বাড়িয়েই থাকে। তুমি যেমন শাড়ির দোকানে গিয়ে দামী শাড়িখানায় হাত বোলাতে বোলাতে বল, মোটে কিন্তু বেশি খরচ করবে না, সস্তা দেখে একখানা–
বলি আমি ওই কথা?
সত্যভাষণের অপরাধে ফাঁকির হুকুম না দিলে বলব, বলে থাকো। তোমার বোনও—
আমি তোমার মতো অত ইয়ে নই। আমি বলে দিয়েছি, যা বলবার মাকে বল গে।
হেমন্ত আরামের হাই তুলে বলে, বলবার কিছু নেই। তারা পাকা দেখার দিন ঠিক করে গেছে।
.
পাকা দেখার দিন ঠিক করে গেছে।
উৎফুল্ল অমলা মেয়েকে দেখেই বলে ওঠেন, ওরা যেতে না যেতেই কোথায় বেরোলি? বলে গেলি না?
আর বলা। তুমি কি আর তখন আমায় চিনতে পারতে মা?
অমলা হেসে ফেলেন।
অমলা বলেন, তা যা বলেছিস। ওরা তো যাবার সময় পাকা দেখার দিন ঠিক করে গেল।
অমলার মুখে পূর্ণচন্দ্রের জ্যোৎস্না।
অমলার কণ্ঠে সপ্তস্করা বেণুর ঝঙ্কার ….
এমন ভদ্র জীবনে দেখিনি বাপু। এই যে হেমন্ত, নিজে সে খুব ভালো। বিয়ের সময় কাকা-টাকা খুব ইয়ে করেছিল। কিন্তু এরা যেন আলাদা জাতের। কনের বাপ হাতজোড় করবে, তা নয় ওরাই করছে, তাড়াহুড়ো করে আপনাদের খুব অসুবিধেয় ফেলেছি, বুঝছি কিন্তু বড্ড ইচ্ছে—আমি তোর বাবাকে বলেছি, ওরা ভদ্র, ওরা কিছু চাইবে না, তা বলে তুমি যেন কমে সেরো না। ধারকর্জ করেও সাধ-আহ্লাদ করবে।…তা, গোছালো মানুষ তো। হাসলেন। বললেন, মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, এ কি আর আমার মাথায় ছিল না? তুই বাপু আর অমন রোদে রোদে হটহটিয়ে বেড়াস নে। যখন-তখন বেরনোটাও বন্ধ কর। চেহারাটা একটু ভালো কর।
অমলার মুখে-চোখে আহ্লাদের ঝিলিক খেলে।
এই অমলার মুখের ওপর বলবে ইলা, থামো মা, পাগলামী রাখো। এ-বিয়ে হবে না। বিয়েই দিতে হবে না তোমার ছোটো মেয়ের। বাবার জমানো টাকা খরচ করতে হবে না।
বলা যায় না।
ইলার মুখ দিয়ে বেরোয় ইলার অভাবিত একটা কথা। আর চেহারা ভালো হয়ে কী হবে? খারাপেই তো–
চলে যায় তাড়াতাড়ি।
অমলা মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মেয়ের দিকে। যৌবনবতী মেয়ের মধ্যেই তো মা জন্ম নেয় নতুন করে। ইলা অমলার সার্থক স্বপ্ন।
৪. ঘরে এসে বসে পড়ে ইলা
ঘরে এসে বসে পড়ে ইলা।
তবে কি বাবাকে বলবে?
বাবা কি বলবেন? আহত পশুর দৃষ্টি নিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকবেন তার সরল ছেলেমানুষ মেয়ের দিকে? না কি, গম্ভীর ক্লান্ত গলায় বলবেন, আর কদিন আগে বললে আর একটা ভদ্রলোকের কাছে অপদস্থ হতাম না।
মুখোমুখি বলা যাবে না।
চিঠি লিখে বলতে হবে। তবু ইলার হাত দিয়েই আসুক আঘাত। সম্বুদ্ধর কথাবার্তা নরম নয়, কি বলতে কি বলে বসবে।
কাগজ টেনে নিয়ে বসল।
আর পরমুহূর্তেই একটা অদ্ভুত চিন্তা পেয়ে বসল ইলাকে।
ওরা তো খুব ভদ্র। অমলা বলেছেন জীবনে এমন ভদ্র দেখেননি। সেই ভদ্রতার কাছেই সাহায্য চাক না ইলা। চিঠি সেখানেই পাঠাক। লিখুক আপনি ভদ্রলোক, তাই আপনাকে জানালাম। গল্প-উপন্যাসে তো এমন হয়।
.
অমলা যেন আহ্লাদের সাগরে ভাসছেন। কত ভয়, কত ভাবনা ছিল, সব কেটে গিয়ে ঝলমলে সূর্যের আলো দেখা দিয়েছে আকাশে, বিচলিত না হয়ে পারছেন না অমলা।
আর কি চায় মানুষ?
আর কি চাইবার আছে?
কৃতী ছেলে, সুন্দর ছেলে, ভদ্র আর মার্জিত ছেলে। তার উপর ব্যবহার-সভ্যতা-কুলশীল মান-অবস্থা সব প্রথম শ্রেণীর। চাওয়ার অতিরিক্তই।
না, অমলা ভাবতে পারেন না এ-সব পাওয়ার অনেক আগে প্রেম চেয়ে বসে আছে ইলা। তাই ভাবেন, ইলার অনেক ভাগ্য।
তা ভাগ্য পরম বইকি।
ইলার সেই চিঠি তো আর কারও হাতেও পড়তে পারত। অথবা অপমানিত বর ঘৃণায় রাগে সে-চিঠি রাষ্ট্র করতে পারত। কদর্য এক কালিতে ভরিয়ে দিতে পারত ইলার মুখ।
অন্তত একখানা কড়া চিঠির মাধ্যমে বলতে পারত ইলাকে, এ-আক্কেলটুকু বড়ো দেরিতে প্রকাশ করা হল না?
নাঃ, সে সব কিছুই হল না। শুধু অমলার আদর্শ ভদ্র ভাবী জামাই ভয়ানক একটা অভদ্রতা করে বসল। বলে পাঠাল মেয়ে পছন্দ হয়নি তার।
মেয়ে পছন্দ হয়নি।
দুটো সংসারের ওপর অতর্কিতে একখানা থান ইট ফেলল যেন ইন্দ্রনীল।
নির্বিবাদে পাকা দেখার আয়োজন হতে দিয়ে, এই দু-তিন দিন ধরে হাস্যমুখে দিদি-বউদিদের হাস্য-পরিহাস হজম করে, এখন বলছে কিনা মেয়ে পছন্দ হয়নি।